ঈদুল ফিতর মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব। এ দিনে মুসলিম সমাজ বেশ আড়ম্বরপূর্ণভাবে দিনটি পালন করে থাকেন। উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে গুরুপাক ও সুস্বাদু খাবার। এ দিন খাবার গ্রহণের ব্যাপারে আমাদের কোনো কোনো সময় মাত্রাজ্ঞান থাকে না। ঈদের দিনে ইচ্ছা মতো যখন তখন খাওয়া যাবে এ বোধটাই অনেকের মধ্যে কাজ করে।
উৎসবের শুরুটাই হয় সকালে এবং আরম্ভ হয় মিষ্টি খাবার দিয়ে। তারপর বিরতিহীনভাবে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে ক্যালরিবহুল খাবার খাওয়া। এক মাসের যে সংযম সেটা আর থাকে না। এই একদিনের অতিভোজনের ফলে পাকস্থলীর ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। কারণ অধিক চাপে পাকস্থলীর পরিপাকে সহায়কারী এনজাইম ঠিকমতো কাজ করতে পারে না।
ফলে পেটে ব্যথা, গ্যাসট্রাইটিস, ডায়ারিয়া, বমি, মাথাব্যথা হতে দেখা যায়। এছাড়া দীর্ঘস্থায়ী রোগ হিসাবে আইবিএস বা ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোমের সূত্রপাত হয়।
* সকালের খবার
ঈদের দিনে প্রতিটি বাড়িতেই মিষ্টির ব্যবস্থা থাকে। যেমন-জর্দা, সেমাই, পায়েস, পুডিং, কাস্টার্ড, ফালুদা ইত্যাদি। এছাড়া থাকে পোলাও, বিরিয়ানি, তেহারি, কোরমা, রোস্ট, রেজালা, কাবাব, চটপটি, ফুচকা, নুড্লস, পাস্তা ইত্যাদি। ইদানীং আবার দেশি খাবারের পাশাপাশি বিদেশি খাবারেরও আধিক্য দেখা যায়। যেমন-মোমো, তিরামিসু, স্যান্ডউইচ, তফু, খাপ্সা ইত্যাদি। ঈদের রান্নায় ঘি, চিনি, দুধ, দই, কিশমিশ, বিভিন্ন ধরনের বাদাম, আলু বোখারা, নারিকেল ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের উপাদান ব্যবহার করা হয়। এতে খাবারের শোভা ও স্বাদ যেমন বাড়ে তেমনি পুষ্টিও পাওয়া যায়। ঘি ক্যারোটিনযুক্ত। এটি দেহে শক্তি সঞ্চার করে। দুধ আমিষের ভালো উৎস। এতে ক্যালসিয়াম প্রচুর রয়েছে। মানুষের অন্ত্রে অনেক সময় জীবাণুর সংক্রমণের জন্য দায়ী। এর ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য, গাঁজানো, পচন ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। দই প্রোবায়োটিক। এতে থাকা ল্যাক্টোবেসিলাস বুলগেরিকাস নামক ব্যাকটেরিয়ার জন্য উপরোক্ত অসুবিধা দূর করে। দই হজমকারক। কিশমিশে লৌহ ছাড়াও অন্য উপাদানের জন্য হৃদরোগী ও কোষ্ঠকাঠিন্যের রোগীদের জন্য স্বাস্থ্যপদ। আজকাল ঈদের খাবারে নারিকেলের ব্যবহার অনেকটা কমে গেছে। নারিকেল দিয়ে ক্ষীর, সেমাই, পোলাও, খাসির মাংস, মুরগির মাংস রান্না করলে বেশ উপাদেয় হয়। হাতে কাটা চালের গুঁড়ার সেমাইয়ের সঙ্গে নারিকেলের ব্যবহার হয়। নারিকেল শরীরে একটা স্নিগ্ধ ভাব আনে এবং ত্বক সুন্দর রাখে ও বুদ্ধির বিকাশে সাহায্য করে।
* দুপুর ও রাতের খাবার
দুপুরে খাবারের সঙ্গে সালাদ, লেবু, চাটনি ও শেষ পাতে দই, বোরহানি, ঘোল থাকলে ভালো হয়। ঘোলের পরিবর্তে লাচ্ছিও খেতে পারেন। পুদিনাপাতা, ধনিয়াপাতা, টমেটো, তেঁতুল, আনারস, আলু বোখারা, আমসত্ত্ব ইত্যাদি দিয়ে চাটনি করা যেতে পারে। এগুলো সবই স্বাস্থ্যসম্মত। যা কিছুই রান্না হোক না কেন, দেখতে হবে সেটাতে যেন অনেক বেশি তেল, ঘি, মসলা না থাকে।
একেক ধরনের অসুস্থতায় খাবারের ব্যাপারে একেক ধরনের নিষেধ থাকে। সুতরাং ঈদের দিন বলে সবকিছুই খাওয়া যাবে অথবা একদিন খেলে কিছুই হবে না, এ ধারণা নিয়ে অসুস্থদের খাবার গ্রহণ করা উচিত নয়। ডায়াবেটিস থাকলে বিকল্প চিনি দিয়ে মিষ্টি তৈরি করা যেতে পারে। বিকল্প চিনি মেশাতে হয় খাবার চুলা থেকে নামানোর পর। তারা খেতে পারেন-স্যুপ, কাবাব, ফুচকা, চটপটি, নুড্লস, খিচুড়ি, বিরিয়ানি, পোলাও, ফ্রায়েড রাইস, লুচি, পরোটা, দইবড়া, রোস্ট, রেজালা ইত্যাদি। গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস থাকলে অনাগত শিশুর কথা চিন্তা করে মিষ্টি খাবার থেকে বিরত থাকলে ভালো হয়। জ্বর থাকলে যদি খাবারে রুচি না থাকে তাহলে শবরত, ফলের রস, স্যুপ, দুধ-সেমাই, পোলাওর চালের নরম ভাত, মাছ বা মুরগির কোরমা খেতে পারেন। হৃদরোগীদের ঘি বা বাটার অয়েলের পরিবর্তে তেলের রান্না ভালো। কিডনি রোগীরা গরু ও খাসির মাংস না খেলেই ভালো করবেন।
সবশেষে বলা যায়, ঈদের দিনে খাবার হবে স্বাস্থ্যসম্মত, টাটকা, পুষ্টিকর ও সহজপাচ্য। এছাড়া সময় ও মাত্রাজ্ঞান রেখে বিরতি দিয়ে খাবার খেতে হবে। আপ্যায়নে রাখতে পারেন ঠান্ডা শরবত বা ফলের রস। এ গরমে এটা স্বস্তি ও প্রশান্তি দেবে।
লেখক: আখতারুন নাহার আলো, চিফ নিউট্রিশন অফিসার ও বিভাগীয় প্রধান (অব.), বারডেম। সভাপতি, ডায়াবেটিস নিউট্রিশনিস্ট সোসাইটি অব বাংলাদেশ, পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, শ্যামলী ও অ্যাডভান্স হাসপাতাল, ঢাকা।