দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের সাতটি অস্ত্র খোয়া গিয়েছিল। যার মধ্যে পরিত্যক্ত স্থান থেকে দুটি শটগান এবং দুটি অস্ত্রের অংশবিশেষ উদ্ধার হয়েছে। তবে বাকি দুটি পিস্তল ও একটি শটগানের কোনো হদিস মেলেনি এখনো। নির্বাচনের ডামাডোলে অস্ত্রগুলো উদ্ধারে পুলিশের তৎপরতায়ও কিছুটা ভাটা পড়েছে। যদিও দুর্বৃত্তদের হাতে থাকা এই অস্ত্রগুলো ব্যবহারের কোনো তথ্য পায়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশ সদস্যদের মনোবল ফেরাতে এবং অবৈধ ব্যবহার রুখতে অস্ত্রগুলো উদ্ধার অত্যন্ত জরুরি।
উদ্ধার না হওয়া তিনটি অস্ত্রের বিষয়ে পুলিশ জানিয়েছে, পিস্তল দুটি সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু মডেলের। এর একটি রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের উত্তর গেটে এক পুলিশ সদস্যকে মারধর করে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। আরেকটি পিস্তল নাইটিঙ্গেল মোড় থেকে খোয়া গেছে। বিজয়নগর এলাকা থেকে লুট হয় একটি শটগান। প্রত্যেকটি ঘটনায় মামলা হয়েছে। তবে অপরাধীদের শনাক্ত করে এখনো অস্ত্রগুলো উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। থানা পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় এগুলো উদ্ধারে কাজ করছে বলে জানিয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) হায়াতুল ইসলাম খান যুগান্তরকে বলেন, অস্ত্র লুটের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাগুলো ধরে আমাদের তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। ঘটনাস্থলের কিছু সিসিটিভি ফুটেজও আমরা সংগ্রহ করেছি। তবে এখনো অস্ত্রগুলো উদ্ধার করতে পারিনি। এখন পর্যন্ত এই অস্ত্রগুলোর ব্যবহারের কোনো তথ্যও আমরা পাইননি।
২৮ অক্টোবরের একটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, পুলিশের একটি দলকে মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন শহীদবাগ মোড় থেকে একদল মানুষ ধাওয়া করে। পুলিশের দলটি হামলাকারীদের ছোড়া ইটপাটকেলের মুখে রাজারবারগ পুলিশ লাইন্সের উত্তর দিক সংলগ্ন মৌচাক অভিমুখে এগোতে থাকেন। হামলাকারীদের থেকে বাঁচতে কিছুক্ষণ পর তারা পুলিশ লাইন্সের দুই নং গেট (শহীদ কনস্টেবল মহিউদ্দিন গেট) দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েন। এ সময় একজন পুলিশ সদস্য কিছুটা পেছনে পড়ে যান। ফলে তিনি আর ঢুকতে পারেননি। তখন ২০-৩০ জন হামলাকারী ঘিরে ধরে তার ওপর হামলা চালায়। একপর্যায়ে নিস্তেজ হয়ে পড়লে কালো শার্ট পরিহিত এক ব্যক্তি তার কোমর থেকে পিস্তলটি বের করে নিয়ে পালিয়ে যায়।
হদিস না পাওয়া শটগানটির বিষয়ে পুলিশ সূত্র জানায়, বিজয়নগর পানির ট্যাংকের কাছে পুলিশের একটি পিকআপ পোড়ানো হয়। সেখানে ইটপাটকেলের মধ্যে এক পুলিশ সদস্য আহত হয়ে পড়েছিলেন। সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ওই জায়গা থেকেই শটগানটি ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে।
ডিবি’র একটি সূত্র জানিয়েছে, ঘটনার বেশ কিছু সিসিটিভি ফুটেজ তাদের কাছেও রয়েছে। অস্ত্রগুলোর কোনো অবৈধ ব্যবহার হচ্ছে কি না-সেদিকেও তাদের গোয়েন্দা নজরদারি রয়েছে। পাশাপাশি কোনো জঙ্গি গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা আছে কি না-তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এ বিষয়ে ডিবির মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, অস্ত্র লুট হওয়ার একটি মামলা আমাদের কাছে আছে। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে অপরাধীদের শনাক্ত করে অস্ত্রগুলো উদ্ধারের সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। তবে এখনো কোনো অগ্রগতি নেই।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক এবিএম নাজমুস সাকিব বলেন, সাধারণত সীমান্ত এলাকা থেকে দেশ অবৈধ অস্ত্র প্রবেশ করে। এগুলো দুষ্কৃতকারীদের হাতে যায়। এবার দেখলাম পুলিশের থেকে বৈধ অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়া হলো। পুলিশ সদস্যদের মনোবল চাঙ্গা করতে এই অস্ত্রগুলো দ্রুত উদ্ধার হওয়া প্রয়োজন। হদিস না পাওয়া অস্ত্রগুলোর অবৈধ ব্যবহারের আশঙ্কার চেয়েও এটি গুরুত্বপূর্ণ।
ডিএমপি সূত্র জানিয়েছে, ২৮ অক্টোবর শনিবারের সমাবেশে সবচেয়ে বেশি পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন কাকরাইল ও নাইটেঙ্গেল এলাকায়। এর মধ্যে নাইটিঙ্গেল মোড় এলাকা থেকে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র খোয়া গেছে। চারটি শটগান হারিয়েছে এই এলাকা থেকে। এর মধ্যে কাকরাইল গ্যারেজ পট্টি থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় দুটি শটগান উদ্ধার হয়েছে। নাইটিঙ্গেল মোড় থেকে আরেকটি গ্যাস গান উদ্ধার হয়। অপর একটি চাইনিজ রাইফেল আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিল হামলাকারীরা। সেটির ভাঙা লোহার একটি অংশ উদ্ধার হয়েছে। সাতটি অস্ত্রের মধ্যে এই চারটি উদ্ধার করতে পেরেছে পুলিশ।
পুলিশের মতিঝিল জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) গোলাম রুহানী বলেন, সেদিন হামলাকারীরা এমনভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে যাতে অনেক সিসিটিভি ক্যামেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে সব ঘটনার পরিষ্কার ফুটেজ আমরা পাইনি। এজন্য আশপাশের ফুটেজগুলোও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, গত শনিবার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পূর্বনির্ধারিত মহাসমাবেশ ছিল। এটি শুরুর আগেই কাকরাইল মোড়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় দলটির নেতাকর্মীদের। পরে শান্তিনগর, নয়াপল্টন, বিজয়নগর, ফকিরাপুল, আরামবাগ এবং দৈনিক বাংলা মোড়সহ আশপাশে এলাকায় তা ছড়িয়ে পড়ে। এসব এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সহিংসতার এই ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন থানায় মামলা হয়।