৫৭ পেরিয়ে ৫৮ বছরে পদার্পণ করেছে পৃথিবীর একমাত্র শাটল ট্রেনের ক্যাম্পাস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)। ১৯৮০ সালে যাত্রা শুরু করা শাটল ট্রেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের প্রধান পরিবহন।
তাই যাত্রা পথে যেখানে শিক্ষার্থীরা লিখেন হাজারও স্মৃতি, গল্পগাথা। আড্ডা কিংবা গানের মূর্ছনায় শাটলের যাত্রা যেন এক ভ্রাম্যমাণ প্রমোদকেন্দ্র।
আয়তনে দেশের সর্ববৃহৎ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ হয়েছে ৫৭ বছর। পাহাড়ের কোলে গড়ে ওঠা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয় ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর। চট্টগ্রাম শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে হাটহাজারীর জোবরা গ্রামে অবস্থিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। তাই শাটল ট্রেন হয়ে আছে শিক্ষার্থীদের নিত্যদিনের সঙ্গী।
শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শাটল ট্রেনেও বেড়েছে ভিড়। তৈরি হয়েছে নতুন নতুন সংকট। স্বপ্নের শাটলট্রেনে ঘুরতে এসে অনেকেই এখন দিবালোকেই দেখেন শাটলের অব্যবস্থাপনার দুঃস্বপ্ন। বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নতুন শাটলট্রেন যুক্ত করার আশ্বাস দিলেও এখনো পুরোনো দুটি ট্রেনই ভরসা শিক্ষার্থীদের। ৯ বগির দুটো শাটলট্রেনে প্রতিদিন গড়ে যাতায়াত করেন হাজারও শিক্ষার্থী। অবশ্য সম্প্রতি নতুন একটি ট্রেনের জন্য পুনরায় আবেদন করেছে কর্তৃপক্ষ। তাই শিক্ষার্থীদের মনেও সঞ্চার হয়েছে নতুন আশা।
চারটি বিভাগ, সাতজন শিক্ষক ও দুইশো শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ৯টি অনুষদে ৪৮টি বিভাগ, ৬টি ইনস্টিটিউট, ৯২০ জন শিক্ষক ও প্রায় ২৮ হাজার শিক্ষার্থী আছেন। এছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য আছে ১৪টি আবাসিক হল ও একটি ছাত্রাবাস।
দেশের অন্যতম এ বিদ্যাপীঠ জন্ম দিয়েছে অনেক গুণীজনের। বরেণ্য মনীষীদের পদচারণায় মুখরিত হয়েছিল এ ক্যাম্পাস। উপ-মহাদেশের খ্যাতিমান ভৌতবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলাম, নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. অনুপম সেন, অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক আবুল ফজল, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ আলী আহসান, মুর্তজা বশীর, ঢালী আল মামুন, সাবেক ইউজিসি চেয়ারম্যান ড. আব্দুল মান্নানসহ বহু কীর্তিমান মনীষী জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে।
চবি শিক্ষক ড. মো. শাহাদাত হোসেনের নতুন মাছের প্রজাতি শনাক্ত এবং প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী রক্ষা ও গবেষণায় অবদানের জন্য শিক্ষক মনজুরুল কিবরীয়া পেয়েছেন দেশি-বিদেশি সম্মাননা। ড. শেখ আফতাব উদ্দিনের কম খরচে সমুদ্র পানি সুপেয় করার পদ্ধতি আবিষ্কার, ড. আল আমিনের লেখা বই যুক্তরাষ্ট্রের ৬টি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের রেফারেন্স বুক হিসেবে নির্বাচন, অধ্যাপক ড. সাইদুর রহমান চৌধুরীর বঙ্গোপসাগর নিয়ে মানচিত্র তৈরিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক নিজ নিজ ক্ষেত্রে রেখেছেন প্রতিভার স্বাক্ষর।
পিছিয়ে নেই শিক্ষার্থীরাও। ব্যাঙের নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করে সর্বকনিষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র সাজিদ আলী হাওলাদার, দেশের সীমানা ছাড়িয়ে চবির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র শাখাওয়াত হাসান ও তার দলের নাম ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে।
এ ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, সিটি করপোরেশন মেয়র, মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ১১ জন সচিব ও ৩০ জন অতিরিক্ত সচিব পদসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চবি শিক্ষার্থীরা দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমান সরকারের তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদও চবির সাবেক শিক্ষার্থী।
দেশের ক্রান্তিকালেও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে অগ্রণী ভূমিকা। ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ, ৯০’র স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধেই শহীদ হয়েছিলেন চবির ১৫ জন।
দেশের অন্যতম এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক ড. আজিজুর রহমান মল্লিক। বর্তমানে ১৮তম ও প্রথম নারী উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এবারও রাখা হয়েছে দিনব্যাপী আয়োজন।
৫৮তম বিশ্ববিদ্যালয় দিবসকে ঘিরে নিজের ভাবনার কথা জানিয়েছেন অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার। তিনি বলেন, আমাদের এখন মূল লক্ষ্য র্যাংকিংয়ে এগিয়ে যাওয়া। আমরা এ ব্যাপারে একটি কমিটি গঠন করেছি। ইতিমধ্যে আমরা বিদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমঝোতা স্বাক্ষর করা হয়েছে। বিদেশি গবেষকদের আমরা একটি ইন্টারন্যাশনাল গেস্ট হাউজও নির্মাণ করা হচ্ছে। গবেষণার জন্য বাড়ানো হয়েছে বরাদ্দ। শিক্ষকরা গবেষণার কথা বললেই আমরা সর্বোচ্চ সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করছি। এছাড়া সেশন জট নিরসনে নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে এখন সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় সেশনজট মুক্ত। সর্বোপরি আমরা আশাবাদি, খুব দ্রুতই র্যাংকিংয়ে প্রবেশ করতে পারবো।