বাংলাদেশের সবচেয়ে নয়নাভিরাম ও অত্যাধুনিক রেলপথের নাম ঢাকা-ভাঙ্গা-যশোর রেলপথ। নতুন এই পথ শুধু পরিবহণ মাধ্যমই নয়, সৌন্দর্য বিলিয়ে আনন্দ দেওয়ার মাধ্যমও। এতে রয়েছে ২৭ কিলোমিটার উড়াল পথ, যা বাড়তি আনন্দ দেবে যাত্রীসাধারণকে। ইতোমধ্যে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত (৮২ কিলোমিটার) একাধিকবার পরীক্ষামূলক যাত্রী ও মালবাহী ট্রেন চালানো হয়েছে। ভাঙ্গা রেলস্টেশনের কাজও প্রায় শেষ। সব মিলে প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন। আগামী ১০ অক্টোবর ঢাকা থেকে ভাঙা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ প্রসঙ্গে রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘রেলে স্বর্ণযুগ আসছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে রেলে আমূল পরিবর্তন এসেছে। এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। শেখ হাসিনা সরকার অব্যাহত থাকলে উন্নত বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশের রেলও এগোবে। ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত নতুন রেলপথটি বিশ্বমানের। ১২০-১৩০ কি.মি গতি নিয়ে ট্রেন চলবে এ পথে। ১০ অক্টোবর ঢাকা-ভাঙ্গা যাত্রীবাহী ট্রেনের শুভ উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। আমরা শুধু বলতে চাই, রেলের সঙ্গে যাত্রীদেরও সুদিন আসছে। পুরো রেলকে বিশ্বমানের করা হচ্ছে।’
সরেজমিন দেখা যায়, কমলাপুর থেকে রাজধানীর শ্যামপুর পর্যন্ত রেলপথের চিত্রটাই পালটে গেছে। কমলাপুরের ৮ থেকে ১১ নম্বর প্ল্যাটফর্ম অত্যাধুনিক আদলে তৈরি করা হয়েছে। প্ল্যাটফর্ম থেকে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন সোজা পৌঁছেছে শ্যামপুর স্টেশন আউটার পর্যন্ত। শ্যামপুর থেকে রেলপথটি উড়াল দিয়ে ধলেশ্বরী নদী হয়ে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে পৌঁছেছে। পরে উড়াল রেলপথটি মাওয়া স্টেশনের খানিকটা দূর থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গার দিকে গেছে। পদ্মা সেতুর নিচে ৬.১৫ কিলোমিটারসহ মোট ২৭ কিলোমিটার উড়াল রেলপথটি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এই রেলপথ উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনসহ আশপাশে রঙের ছোঁয়া লাগছে। নতুন লাইন ঘেঁষে ব্যানার-ফেস্টুন টানানো হচ্ছে।
এদিকে ভাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশনের কাজও শেষ পর্যায়ে। প্রায় ২শ কোটি টাকা ব্যয়ে স্টেশনটি তিনতলাবিশিষ্ট। ১২টি প্ল্যাটফর্ম সমন্বয়ে স্টেশনটি দেশের সর্ববৃহৎ স্টেশন। একপ্রকার ‘হাব’ সিস্টেমের এ স্টেশনে যাত্রী সুরক্ষা এবং সেবা নিশ্চিতসহ সব ধরনের ব্যবস্থা থাকছে। অর্থাৎ ঢাকা-যশোর রেলপথের অন্যতম স্টেশন হচ্ছে ভাঙ্গা। এ স্টেশনটিতেও রঙের ছোঁয়া লাগছে।
পরীক্ষামূলক চলাকালে ট্রেন পদ্মা সেতুর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার রেলপথ মাত্র ৩ মিনিট ৮ সেকেন্ডে পাড়ি দিয়েছে। ১৫ ও ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার গতি নিয়ে ট্রেন চলে। এর আগে পরীক্ষামূলকভাবে ৭ সেপ্টেম্বর কমলাপুর থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা; এরপর ভাঙ্গা থেকে আবারও পদ্মা সেতু হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত চলে একটি যাত্রীবাহী ট্রেন। ওই ট্রেনে প্রায় সাড়ে ৪শ যাত্রী ছিল। গড়ে গতি উঠানো হয়েছিল ৬৭ কিলোমিটার। ৭ সেপ্টেম্বরের পর এ পর্যন্ত আরও তিনবার যাত্রী ও মালবাহী ট্রেন চলেছে। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগে আরও বেশ কয়েকবার পূর্ণ গতি নিয়ে ট্রেন চালানো হবে বলে জানিয়েছেন রেলওয়ে অপারেশন দপ্তর।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের আমন্ত্রণে উড়াল রেলপথ ঘুরে দেখা গেছে, অসাধারণ সব দৃশ্য। এ পথে চলবে এমন ১০০টি বিশেষ কোচ ক্রয় করা হয়েছে-যা রেলবহরে যুক্ত হয়েছে। রেলে বর্তমানে সর্বোচ্চ ১৬টি কোচ নিয়ে ট্রেন চলাচল করছে।
শ্যামপুর থেকে সিরাজদিখান পর্যন্ত উড়াল রেলপথে চড়ে দেখা যায়, পুরো পথ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পূর্ণ। শুধু নদী বা জলাশয় নয়, রয়েছে সারি সারি টিন-কাঠের তৈরি দ্বি-তল বাড়ি। আবাসিক ভবন, কলকারখানাসহ সুবিস্তৃত ধানের খেত ও নারিকেল গাছের সারি। এটি দেশের অন্যতম আধুনিক রেলপথ, যা দিয়ে আধুনিক ট্রেন চলবে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে যাত্রীরা দিগন্তজোড়া সৌন্দর্য দেখতে পারবেন।
রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার সাহাদাত আলী জানিয়েছেন, এ পথে ৩ জোড়া অর্থাৎ ৬টি ট্রেন চালানো হবে। ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত ট্রেন চলবে। তখন ঢাকা-যশোর পর্যন্ত অন্তত ২২টি ট্রেন চালানো সম্ভব হবে। তিনি বলেন, ‘এ পথে পর্যটক ও সাধারণ মানুষ ভ্রমণ করতে ব্যাকুল হয়ে উঠবেন।’
ট্রেনের কোচগুলো ঘুরে দেখা যায়, স্টেনলেস স্টিল দিয়ে তৈরি কোচগুলোতে বড় বড় কাচের জানালা। দেশে এই প্রথম এ ধরনের কোচ। আসনগুলো সাধারণ ট্রেনের প্রায় দ্বিগুণ। আছে সিসি ক্যামেরা, ইমার্জেন্সি অ্যালার্ম, প্যাসেঞ্জার অ্যাড্রেস সিস্টেম, প্যাসেঞ্জার ইনফরমেশন সিস্টেম, ওয়াইফাই, এলইডি টিভি, মোবাইল চার্জের পয়েন্ট, এলইডি আলো, অত্যাধুনিক টয়লেটসহ নানা ব্যবস্থা। ডেস্টিনেশন বোর্ডের মাধ্যমে যাত্রীরা পরবর্তী স্টেশন সম্পর্কে জানতে পারবেন।
সড়কপথে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পৌঁছতে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা লাগে। যানজট থাকলে দ্বিগুণ সময়ও লেগে যায়। কিন্তু রেলপথে ওই দূরত্ব অতিক্রম করতে লাগবে মাত্র ১ ঘণ্টা ৫ থেকে ১০ মিনিট। আধুনিক রেলপথ-ট্রেন এবং আরামদায়েক ভ্রমণের জন্য যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি কোনো ভাড়া নেওয়া হবে না।
ঢাকা-যশোর পদ্মা সেতু রেল লিংক প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী আফজাল হোসেন বলেন, রেলপথটি নতুন মাত্রায় সুন্দর্য ছাড়াচ্ছে। যাত্রীরা মন ভরে তা উপভোগ করতে পারবেন। শহর, নদী-নালা, খাল-বিল, গ্রাম-বসতির ওপর দিয়ে সব মিলিয়ে প্রায় ২৭ কিলোমিটার উড়াল রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে; যা বিশ্বমানের, অত্যাধুনিক-প্রযুক্তি সম্পন্ন। আমরা প্রায় সব কাজই সম্পন্ন করেছি। ভাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশনের শেষ ভাগের কাজ চলছে। আমরা ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার যাত্রী ও মালবাহী ট্রেন চালিয়েছি।
রেলওয়ে মহাপরিচালক প্রকৌশলী কামরুল আহসান জানান, ১০ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রীবাহী ট্রেনের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কমলাপুর কিংবা ভাঙ্গা স্টেশন থেকে কার্যক্রম শুরু হবে। এখনো চূড়ান্ত হয়নি কোথা থেকে ট্রেনটির যাত্রা শুরু হবে। আমরা দুই জায়গায় প্রস্তুতি সম্পন্ন করছি। নতুন এ রেলপথ হবে দেশের সেরা রেলপথ। শব্দ যেমন কম হবে, তেমনি ট্রেনও চলবে মসৃণ।