‘ওই যে দেখুন সাদা কম্বল ও কিছু আসবাব এখনো দেখা যাচ্ছে। বাকি সব মাটির সঙ্গে মিশে গেছে’, বিষাদের সুরে বলে উঠলেন আব্দো রহমান।
স্ত্রী-সন্তান হারিয়ে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছেন ধ্বংস হওয়া বালি-পাথরের স্তূপের দিকে। পেট্রোল পাম্প থেকে চিৎকার করতে করতে ছুটে এসেছিলেন পরিবারকে বাঁচাতে। কিন্তু তার আর্তনাদ পৌঁছাল না হিংসাত্মক ভূমিকম্পের কানে। গভীর রাতের নির্মম ভূমিকম্পের গ্রাসে হারিয়ে ফেলেন ঘর-সংসার। সাজানো-গুছানো আনন্দে ভরপুর বাড়ির ধ্বংসস্তূপে তিন ছেলে ও স্ত্রীর লাশ খুঁজে পান। কবর দেন নিজ হাতেই।
মরক্কোর অ্যাটলাস পর্বতমালার তাফেঘাঘতে গ্রামের বাসিন্দা। ভয়াবহ ভূমিকম্পে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে পুরো গ্রাম। যার অর্ধেক বাসিন্দাই এখন মৃত। গ্রামের ২০০ বাসিন্দার মধ্যে ৯০ জনের মৃত্যুর খবর সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আরও অনেকেই নিখোঁজ রয়েছেন। বিবিসি।
২০ সেকেন্ডেই শেষ হয়ে গেছে সব। মৃত্যুর মিছিলে ভরে গেছে পুরো দেশ। থামার কোনো নাম নেই। নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২ হাজার ৪৯৭ জনে দাঁড়িয়েছে। আহতের সংখ্যাও ক্রমশ বাড়ছে। সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪২১ জনে। দেশটির অনেক স্থানেই বাড়িঘর ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। জরুরি নিরাপত্তাকর্মী ও উদ্ধারকারীরা জীবিতদের বাঁচাতে প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। তবে অনেক অঞ্চলেই উদ্ধারকারীরা পৌঁছাতে পারেননি।
বিবিসির প্রতিনিধিরা পরিস্থিতি দেখতে মরক্কোর বিভিন্ন অঞ্চল পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাফেঘাঘতে গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে দেখা করে গ্রামের পরিস্থিতির একটা আনুমানিক ধারণা নেন। প্রথম দেখা হওয়া বাসিন্দা বলেন, ‘এই গ্রামের সব মানুষ হয় হাসপাতালে আর না হয় মৃত।’
মরক্কোর এমন বিপর্যয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে স্পেন। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ৫৬ জন উদ্ধারকর্মীর সঙ্গে চারটি কুকুরসহ একটি বিমান উদ্ধার অভিযানে যোগ দিতে মরক্কোয় পাঠানো হয়েছে। স্পেন ছাড়াও ব্রিটেন, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে সহায়তা পেয়েছে মরক্কো সরকার। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেন, ‘সব ধরনের প্রযুক্তিগত এবং নিরাপত্তা দলকে পাঠাতে প্রস্তুত আছি আমরা। মরক্কোর কর্তৃপক্ষ প্রয়োজন মনে করলে আমরা সহায়তা পাঠাতে দেরি করব না।’
বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, আফ্রিকান ইউনিয়ন ও ইউরোপীয় কমিশনও প্রযুক্তিগত এবং আর্থিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কয়েক বছর সময় লাগতে পারে বলে মনে করছে রেড ক্রস।
গ্রামের ঢুকতে ঢুকতেই এ কথার প্রমাণ পাওয়া যায়। জানা যায়, গ্রামের পুরোনো ধাঁচের বাড়িগুলো এমনভাবে ইট ও পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে, যা কোনোভাবেই এই মাত্রার ভূমিকম্প সামাল দেওয়ার মতো উপযুক্ত ছিল না। ধ্বংসস্তূপের ওপরে উঠে আসা হাসান জানান, তার চাচা এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে। তাকে সেখান থেকে বের করার কোনো সম্ভাবনাও নেই। তিন দিন হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত উদ্ধারকর্মীরাও এসে পৌঁছাতে পারেনি এ গ্রামে। ধ্বংসস্তূপ খোঁড়ার মতো প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও নেই। এদিকে রাতে ফোনের মধ্যে অনেক ডাকাডাকি করেও ফোনে প্রেয়সীর গলা আর শুনতে পাননি মরক্কোর তিখত গ্রামের বাসিন্দা ওমর আইত এমবারেক (২৫)। কয়েক সপ্তাহ পরেই প্রেমিকা মিনার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। হঠাৎ কম্পনে মাটির সঙ্গে মিশে যায় মিনার দেহ। এমবারেকের জীবন থেকে চিরতরের জন্য হারিয়ে যায়। আটলাস পর্বতমালা থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরের তিখত গ্রামটিও রাতারাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
দেশটির বিভিন্ন জায়গায় এখনো নিচে চাপা পড়ে আছেন অসংখ্য মানুষ। যারা বেঁচে আছেন, তাদের জীবিত উদ্ধারের আশা ক্রমশ ক্ষীণ হচ্ছে। কারণ, আটলাস পর্বতমালার মতো মরক্কোর অনেক অঞ্চলেই জরুরি সেবা পৌঁছাতে পারেছে না। ধ্বংসের ফলে পথঘাট অবরুদ্ধ হওয়ায় বেশকিছু জায়গায় যেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে দেশটির কর্তৃপক্ষকে। তবুও জীবিত মানুষকে উদ্ধারের আশায় উদ্ধারকর্মীরা সন্ধান করছেন। বিভিন্ন এলাকায় গ্রামবাসীরাই করছেন উদ্ধারের কাজ। যতটুকু পারছেন, হাত দিয়ে বা তাদের কাছে থাকা বেলচা, শাবল দিয়ে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে আটকে পড়া মানুষ উদ্ধার করছেন। আবার ওই বেলচা আর শাবল দিয়েই মরদেহের জন্য কবরও খুঁড়ছেন। বিবিসিকে অন্য একটি গ্রামের একজন বাসিন্দা বলেন, মানুষের কাছে আর কিছুই বাকি নেই। গ্রামে কোনো খাবার নেই, শিশুরা পানির পিপাসায় কষ্ট পাচ্ছে। রাস্তার পাশে তাঁবুতে আশ্রয় নিয়েছেন অসংখ্য মানুষ।