সাইবার নিরাপত্তা বিল থেকে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট বাদ দেওয়াসহ কিছু বিষয় সংশোধন করা হলেও বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার ও তল্লাশির সুযোগ থাকছেই। তবে সংশোধন করা বিষয়গুলো মূলত শব্দগত পরিবর্তন। এর বাইরে বিলের একটি ধারা বাদ দেওয়া হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (৭ সেপ্টেম্বর) ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সাইবার নিরাপত্তা বিলের কয়েকটি ধারা সংশোধনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে সাংবাদিকদের কয়েকটি সংগঠনের নেতারা বিশেষ আমন্ত্রণে উপস্থিত থেকে বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা বাতিলের দাবি জানান। তবে কমিটি এই ধারা বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪৩ ধারায় এই বিধান ছিল, এখন সাইবার নিরাপত্তা বিলের ৪২ ধারায় এই বিধান যুক্ত করা হয়েছে। দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে সরকার বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে সাইবার নিরাপত্তা আইন করতে যাচ্ছে। গত মঙ্গলবার সাইবার নিরাপত্তা বিল সংসদে তোলা হয়। এর পর বিলটি পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়।
মন্ত্রিসভায় চূড়ান্ত অনুমোদনের পরদিন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, বিলটি সংসদীয় কমিটিতে গেলে সেখানে অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। বৃহস্পতিবার বৈঠকে সংসদীয় কমিটির আমন্ত্রণে শুধু সাংবাদিকদের কয়েকটি সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। তাদের সবাই কমিটির সিদ্ধান্তে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হননি।
বৈঠকে অংশ নেওয়া সংশ্লিষ্টরা জানান, বিলের ২১ ধারায় শব্দগত পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রোপাগান্ডা ও প্রচারণা-সংক্রান্ত অপরাধের কথা বলা আছে। এখানে ‘প্রোপাগান্ডা ও প্রচারণার’ বদলে ‘বিদ্বেষ, বিভ্রান্তি ও কুৎসামূলক প্রচারণা’ প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বৈঠকে বিলের ৩২ ধারা বাতিল করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই ধারায় অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট যুক্ত করা হয়েছিল। ডিজিটাল মাধ্যমে কেউ অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টভুক্ত অপরাধ করলে তার সাজার বিধান করতে এটি যুক্ত করা হয়েছিল।
বিলের ৪২ ধারায় বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া আছে পুলিশকে। এটি বাদ দেওয়ার দাবি ছিল সাংবাদিকদের। তবে তা কিছুটা সংশোধন করে বহাল রাখা হচ্ছে। এতে সংশোধনী এনে বলা হচ্ছে, এই ধারায় পুলিশ পরিদর্শক পর্যায়ের কর্মকর্তা বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি ও গ্রেপ্তার করতে পারবেন। আগে সাব-ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার কর্মকর্তার কথা ছিল।
বৈঠকে বিশেষ আমন্ত্রণে অংশ নেওয়া আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা অনেক পরিবর্তন করেছি। ২১ ধারার বিষয়ে বিএফইউজে-বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন থেকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, আমরা তা গ্রহণ করেছি। ৩২ ধারার অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট বাতিল করে দিয়েছি, এ আইনে সেটা থাকবে না।’
বৈঠক শেষে সিনিয়র সাংবাদিক মনজরুল আহসান বুলবুল বলেন, কমিটি কিছু বিষয়ে সংশোধনী এনেছে। ৪২ ধারায় (বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি ও গ্রেপ্তার) সাব-ইন্সপেক্টর পর্যায়ের কর্মকর্তার স্থলে ইন্সপেক্টর পর্যায়ের কর্মকর্তা করা হয়েছে। তিনি বলেন, তারা এ বিষয়টিতে সন্তুষ্ট নন। তারা প্রেস কাউন্সিলের কথা বলেছেন।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, ২১, ৩২ ধারাসহ কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংশোধনী আনা হয়েছে। ৪২ ধারায় সংজ্ঞায় কিছুটা সংশোধন আনা হয়েছে। দু-একদিনের মধ্যে সংশোধিত খসড়া আইন ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে।
বৈঠকে ১৪ দফা দাবি জানিয়েছিল বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজের একাংশ)। বৈঠক শেষে এই অংশের সভাপতি এম আবদুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, কমিটি কয়েকটি দাবি মেনে নিয়েছে। দু-একটি জায়গায় ভাষাগত পরিবর্তন এনেছে। তবে তারা এতে সন্তুষ্ট নন। বৈঠকে তারা বলেছেন, স্বাধীন সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত হয়ু এমন ধারাগুলো বাতিল করে সংশোধনী আনা হলেই শুধু তারা মেনে নেবেন।
বৈঠক শেষে সংসদ সচিবালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বৈঠকে সাইবার নিরাপত্তা বিলের ওপর আলোচনা শেষে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সংশোধিত, সংযোজিত ও পরিমার্জিত আকারে সংসদে প্রতিবেদন উত্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সংসদীয় কমিটির সভাপতির অনুপস্থিতিতে কমিটির সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিকের সভাপতিত্বে সংসদ ভবনে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কমিটির সদস্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ, ফাহমী গোলন্দাজ, আহমেদ ফিরোজ কবির, মো. নুরুল আমিন, মনিরা সুলতানা এবং জাকিয়া পারভীন খানম বৈঠকে অংশ নেন।
সভাপতির বিশেষ আমন্ত্রণে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বৈঠকে অংশ নেন। এ ছাড়া প্রেস ক্লাব সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন, বিএফইউজে একাংশের মহাসচিব দীপ আজাদ, বিএফইউজে আরেক অংশের মহাসচিব নুরুল আমিন রোকন, ডিইউজের সভাপতি সোহেল হায়দার চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসেন প্রমুখ বিশেষ আমন্ত্রণে উপস্থিত ছিলেন।
আইনটির খসড়া প্রকাশের পর থেকেই মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন বলে আসছে, সাইবার নিরাপত্তা আইনেও কার্যত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মূল বিষয়বস্তু বহাল রাখা হচ্ছে। প্রস্তাবিত আইনে কিছু ক্ষেত্রে সাজা কমানো ও জামিনযোগ্য ধারা বাড়ানো হলেও অপরাধের সংজ্ঞা সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। তাই মানুষকে হয়রানি করার সুযোগ থেকেই যাবে।
বিলটি সংসদে তোলার সময় আপত্তি জানিয়ে জাতীয় পার্টির সদস্য ফখরুল ইমাম গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, কিছু ক্ষেত্রে সাজা কমানো হলেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে প্রস্তাবিত আইনটির মৌলিক পার্থক্য নেই। টিআইবি বলেছে, এভাবে সাইবার নিরাপত্তা আইন পাস হলে তা হবে কালো আইন।