দেশে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। দিনে-রাতে বেশীরভাগ সময় পায়রা কেন্দ্র থেকে উৎপাদন সক্ষমতার সমান বিদ্যুৎ নেয়া হচ্ছে। ফলে রক্ষণাবেক্ষনে যথেষ্ট সময় মিলছেনা। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির যন্ত্রপাতির ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিককে, কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রেগুলোতে যে পরিমাণ কয়লা মজুদ (রিজার্ভ) থাকা প্রয়োজন, সেই মজুদ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। আবার পিডিবির কাছে বকেয়া বিলের পরিমানও কম নয়। তাই সব মিলিয়ে বহুমুখী সঙ্কটে পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
নিবরচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যহত রাখতে ১৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রে ৫০-৬০ দিনের কয়লা (জ্বালানি) মজুদ রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে প্রতিদিন ১২-১৩ হাজার আবার কোনদিন ১৪ হাজার মেট্রিক টন কয়লা লাগে। দৈনিক জ্বালানি চাহিদা ১২ হাজার মেট্রিক টন ধরা হলেও এই কেন্দ্রে ৫০ দিনে অন্তত ৬ লাখ মেট্রিক টন কয়লা রিজার্ভ থাকা জরুরী।
কয়লা মজুদ নিশ্চিত রাখতে পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রে ৪টি কোলডোম স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটির মজুদ সক্ষমতা প্রায় দেড় লাখ মেট্রিক টন। এক সময় এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৫-৬ লাখ মেট্রিক টন কয়লা রিজার্ভ থাকলেও এখন কোলডোম গুলো প্রায় ফাঁকাই বলা চলে। অনুসন্ধানে জানা যায়, বর্তমানে প্রতিটি কোলডোমে গড়ে ২০ হাজার মেট্রিক টনের মতো কয়লা মজুদ রয়েছে।
পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরো সক্ষমতায় চললে প্রতিদিন ১৩-১৪ হাজার মেট্রিক টন কয়লা লাগে। ইন্দোনেশিয়া থেকে ৩দিন পরপর একটি করে জাহাজ আসে। প্রায় ৫৫ হাজার মেট্রিক টন সক্ষমতার এসব জাহাজ নাব্যতা সংকটের কারণে ৩৫-৪০ হাজার মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে পায়রার জেটিতে আসে। এই পরিমাণ কয়লা খালাশ করে কোলডোমে নিতেও সময় প্রয়োজন হয়। বলা যায়, এখন পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটির অবস্থা অনেকটা ‘দিন আনে দিন খায়’ এর মত।
উল্লেখ্য ডলার সংকটে কয়লা আমদানীর বিশাল বকেয়া পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় পায়রায় কয়লা সরবরাহ বন্ধ করে দেয় ইন্দোনেশিয়ার কোলমাইনিং কোম্পানি। এর আগে তারা চিঠি দিয়ে বকেয়া পরিশোধের তাগাদা এবং সময় দিলেও যথা সময়ে ডলার সংস্থান করতে পারেনি পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। ফলে কয়লা আসা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর কোলইয়ার্ডের রিজার্ভ কয়লা দিয়ে চলতে থাকে পায়রা। আর কর্তৃপক্ষ ডলার জোগাড়ের চেষ্টায় দৌড়ঝাপ করতে থাকেন। তবে শেষ রক্ষা হয়নি তখন। ফলে গেল জুন মাসে বেশ কিছুদিন পুরোপুরি বন্ধ ছিল পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র।
সরকার জুন মাসের শুরুতে ডলারের ব্যবস্থা করে দিলেও এলসি খোলাসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষে ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা পায়রার কোলডোমে পৌঁছাতে কিছুটা সময় লাগে। ২৫ জুন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির একটি ইউনিট পুনারায় উৎপাদনে ফেরে। কয়লার চালান আসা বাড়তে থাকলে কিছুদিন পর চালু হয় দ্বিতীয় ইউনিট।
উৎপাদন বিবেচনায় পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও দক্ষতার বিচারেও দেশের অন্যতম সফল বিদ্যুৎকেন্দ্র এটি। গড়ে দেশের দৈনিক মোট চাহিদার প্রায় ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ যোগান দেয় কেন্দ্রটি।
পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শাহ আব্দুল হাসিব গণমাধ্যমকে বলেন, আগে কয়লার যে সঙ্কট ছিল সেটা অনেকটাই সামাল দেয়া গেছে। বর্তমানে কয়লার মজুদ আছে ৮৪ হাজার মেট্রিক টন। শিগগির মজুদ ১ লাখ টনের উপরে নেয়া সম্ভব হবে বলে আশা করছি। তবে আগের অবস্থায় যেতে সময় লাগবে। তাই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদনের চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি থাকছে।
তিনি জানান, রুটিন অনুযায়ী ডিসেম্বর থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষন কাজ শুরু হবে। তখন পর্যায়ক্রমে একটি ইউনিট বন্ধ রেখে অপরটি চালু রাখা হবে। দুটো ইউনিটের রক্ষাণাবেক্ষনে ৪ মাস সময় লাগবে।
তিনি বলেন, সময়মতো অর্থ পাওয়া গেলে এবং কোন ধরনের সংকট না থাকলে একটি ইউনিট বন্ধের সুযোগে ৫ থেকে ৬ লাখ টন কয়লা মজুদ করা সম্ভব হবে। তার আগে পূর্ন ক্ষমতায় বিদ্যুৎকেন্দ্র চালিয়ে কাঙ্খিত কয়লার মজুদ করা কঠিন হবে বলেই মন্তব্য করেন তিনি।
কয়লা রিজার্ভের বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম তামিম বাংলাভিশনকে বলেন, প্রতিটা কয়লা বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড হলো দুই মাসের কয়লা (জ্বালানি) কোলইয়ার্ডে রিজার্ভ রাখতে হয়। কোন কারণে যদি সাপ্লাইয়ে চেইনে সমস্যা হয়, তখন রিজার্ভ থেকে উৎপাদন চালু রাখা হয়। তার মতে, কয়লার মজুদ বাড়াতে হলে টাকা লাগে। কিন্তু টাকার যোগান নেই। ফলে সমস্যাটা চলমান থাকতে পারে আরো কয়েকমাস। তবে যে করেই হোক পায়রাতে কয়লার রিজার্ভ নিশ্চিতে ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন সঙ্কটে পড়তে পারে।
বিদ্যুৎ বিভাগের একটি সূত্রে জানা যায়, পায়রা থেকে পুরো উদ্যোমে বিদ্যুৎ নিলেও নিয়মিত বিল পরিশোধ করছে না পিডিবি। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ি, পিডিবির কাছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা (৬ মাসের বিল) পাওনা হয়েছে পায়রা।
সার্বিক বিষয় প্রসঙ্গে পিডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি একটি বেইজ-লোড প্ল্যান্ট। দেশে ছোট ছোট অনেকগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র মিলিয়েও এর সমান বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব নয়। তাই এই বিদ্যুৎকেন্দ্রেটি যাতে কোন ঝুঁকিতে না পরে সেদিকে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের নজর রাখা উচিৎ।
তিনি বলেন, বেসরকারি ছোট ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বিল পরিশোধ করা হচ্ছে। তবে পায়রার প্রায় ছয় মাসের বিল আটকা পড়ে গেছে। যদিও এ বিষয়ে পিডিবি কর্তৃপক্ষ সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের সঙ্গে আলোচনা অব্যহত রেখেছে বলেও জানান তিনি।
পিডিবির কাছে পায়রা প্ল্যান্টের বকেয়া ৬ হাজার কোটি টাকার বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে বিল পরিশোধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত সরকারের। বিল না পেলে কয়লা কেনা সম্ভব হবেনা। ফলে নিশ্চিতভাবেই সঙ্কটে পড়বে বিদ্যুতের উৎপাদন।
পায়রায় কয়লা মজুদে যে সংকট এখন তৈরী হয়েছে, সেদিকে নজর দেওয়া জরুরী বলে মনে করেন তারা।
তারা বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোন কারণে যদি আবার কয়লা আসা বন্ধ হয়, সেই বিবেচনায় অন্তত দেড় থেকে দুই মাস যাতে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে উৎপাদনে রাখা যায়, সে ব্যবস্থা এখনই করে দিতে হবে। প্রয়োজনে সক্ষমতার ৬০-৭০ শতাংশ বিদ্যুৎ নিয়ে পায়রাকে রিজার্ভ বিল্ড-আসের সুযোগ করে দিতে হবে। তা না হলে, যেকোন সময় আবার বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে, বিদ্যুৎ সরবরাহে এর প্রভাব পড়বে। তখন লোডশেডিং দিয়েও গ্রাহক চাহিদা পূরণে পিডিবিকে হিমশিম খেতে হবে।
কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াটের এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নিজস্ব চাহিদা পূরণের পর সর্বোচ্চ প্রতিদিন ১২৪৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারে।