মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের অধীন বিজি প্রেসের জন্য সিক্সকালার প্রিন্টিং মেশিন ক্রয়ে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালকের (ডিজি) বিরুদ্ধে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে কোটি টাকা ঘুস দাবির অভিযোগ উঠেছে। ওই প্রতিষ্ঠান এত টাকা ঘুস দিয়ে মেশিন বিক্রয়ে অপারগতা প্রকাশ করলে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে একই মেশিন ক্রয়ে তিনি ৭৫ লাখ টাকা ঘুস দাবি করেন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি ৭৫ লাখ টাকা ঘুস দিতে রাজিও হয়। এই আলোচনার মধ্যেই তৃতীয় প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আরও বেশি পরিমাণ ঘুস নিয়ে প্রিন্টিং মেশিন ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
এখানেই শেষ নয়। সরকারি বিভিন্ন প্রকাশনা ও বই কিংবা ম্যাগাজিন ছাপার কাজের জন্য সিক্সকালার প্রিন্টিং মেশিনটির বাজার মূল্য সাড়ে ৭ কোটি টাকা। সেই মেশিন ক্রয়ে সরকারি বরাদ্দ প্রায় ১৬ কোটি টাকা। সর্বনিম্ন দরদাতার দরপ্রস্তাব ছিল ১৫ কোটি ২২ লাখ টাকা। ডিজি যে প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন তাদের দরপ্রস্তাব হচ্ছে ১৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা। অর্থাৎ সর্বনিম্ন দরদাতার চেয়ে ৪০ লাখ টাকা বেশি মূল্যে মেশিনটি ক্রয়ের উদ্যোগ নেন তিনি। ঘুস দাবি এবং সর্বনিম্ন দরদাতার কাছ থেকে না কিনে বাড়তি ৪০ লাখ টাকা দিয়ে মেশিন কেনার উদ্যোগ নেওয়াসংক্রান্ত অভিযোগটি মন্ত্রণালয়ের কানে গেলে তা তদন্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
জানা গেছে, বিজি প্রেস একটি সিক্সকালার প্রিন্টিং মেশিন ক্রয়ের জন্য চলতি বছরের ৮ এপ্রিল টেন্ডার আহ্বান করে। এতে দুটি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে। এগুলো হলো-কেবিএ এবং জিসান ইন্টারন্যাশনাল। আর টেন্ডারে অংশ নেওয়ার আগেই হাইডেল বার্গ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মেশিন ক্রয় করার জন্য আলোচনা করেন মহাপরিচলক। তাদের কাছে এক কোটি টাকা ঘুস দাবি করেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি ঘুস দিতে রাজি হয়নি। পরে তারা টেন্ডার প্রক্রিয়া থেকে সরে যায়।
পরে টেন্ডারে অংশগ্রহণকারী দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কেবিএ’র কাছ থেকে মেশিন ক্রয়ে ৭৫ লাখ টাকা ঘুস চান ডিজি। তাদের সঙ্গে ঘুসের টাকার লেনদেন নিয়ে আলোচনার সময় জিসান ইন্টারন্যাশনালের কাছ থেকে মের্শিন ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেন মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের একেএম মাসুদুজ্জামান।
সূত্র জানায়, এ পর্যায়ে সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়া সত্ত্বেও কাজ না পেয়ে কেএবি’র চেয়ারম্যান আলী আমজাদ হোসেন ক্ষুব্ধ হয়ে জনপ্রশাসন সচিব ও সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) কাছে প্রতিকার চেয়ে অভিযোগ করেন। এরপরই বিষয়টি জানাজানি হয়। এ পর্যায়ে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়ে সিপিটিও এই কার্যাদেশ বাতিল করে দেয়।
অভিযোগের বিষয়ে কথা বলার জন্য মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তরে গিয়ে ডিজিকে পাওয়া যায়নি। পরে তার ব্যক্তিগত ও দাপ্তরিক ফোন নম্বরে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। খুদেবার্তা দিলেও তিনি সাড়া দেননি। গত দুদিন ধরে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা কিংবা বক্তব্য নেওয়ার সব ধরনের চেষ্টা করা হয় যুগান্তরের পক্ষ থেকে। কিন্তু তিনি সাড়া দেননি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী রোববার যুগান্তরকে বলেন, মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের ডিজিসহ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিষয়গুলো নিয়ে কাজ চলছে।
ডিজির বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে আরও বেশ কিছু অভিযোগ জমা পড়েছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে রয়েছে গভর্মেন্ট প্রিন্টিং প্রেসে শাখার অব্যবহৃত কোটি টাকা মূল্যের পিএস প্লেট উচ্চমূল্যে বিক্রি করেন তিনি। কিন্তু কাগজপত্রে নামমাত্র মূল্যে বিক্রয় দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেন। বিশেষ সুবিধার বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানটির যেসব পদে ওভারটাইম রয়েছে ওই পদে চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের বদলি করেন। যেসব ক্যাডার কর্মকর্তা তার কাজে দ্বিমত পোষণ করেন তাদের রাতারাতি অন্যত্র বদলি করেন। সংস্থাটির লাখ লাখ টাকা মূল্যের পুরনো আসবাবপত্র মাত্র ১২ হাজার টাকায় বিক্রি করে লাভবান হয়েছেন।
অভিযোগে আরও বলা হয়, মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তরে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার অফিস সরঞ্জাম, কাজগপত্র, দাপ্তরিক কাজে ব্যবহৃত যাবতীয় স্টেশনারিজ কেনাকাটা হয়। সব শাখার কেনাকাটায় ১৫ শতাংশ কমিশন আদায়ের মৌখিক নির্দেশ দেন মহাপরিচালক। তার এমন অন্যায় আদেশের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে সংস্থা থেকে স্বেচ্ছায় বদলি হয়ে যান উপপরিচালক (উপসচিব) হাসিনা বেগম। সংস্থাটির আরেক উপপরিচালক ব্রেনজন চাম্বুগং মহাপরিচালকের অন্যায় আবদারের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করায় তাকেও বদলি করা হয়। অবশ্য পরে বদলি আদেশ স্থগিত করা হয়।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ইস্কাটন নাভানা টাওয়ারে একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে মহাপরিচলক একেএম মাসুদুজ্জামানের। ওই ফ্ল্যাটের যাবতীয় আসবাবপত্র তিনি বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে উপহার হিসাবে নিয়েছেন। সোনালী ব্যাংকের একটি হিসাবে তিনি ১৬ কোটি টাকা লেনদেন করেছেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, কয়েক মাস আগে এমআইসিআর চেক বই প্রিন্টিং মেশিন ক্রয়ে সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ না দিয়ে সর্বোচ্চ দরদাতাকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। বিষয়টি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পৃথকভাবে তদন্ত করছে বলে জানা গেছে।
সূত্র- যুগান্তর