ফ্রিডম বাংলা নিউজ

শুক্রবার, এপ্রিল ২৬, ২০২৪ |

EN

পিরোজপুরে শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদের ৫২ তম শাহাদাৎ বার্ষিকী পালন

শাফিউল মিল্লাত, পিরোজপুর প্রতিনিধি | আপডেট: শুক্রবার, মে ৫, ২০২৩

পিরোজপুরে শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদের ৫২ তম শাহাদাৎ বার্ষিকী পালন
পিরোজপুরে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ফয়জুর রহমান আহমেদের ৫২ তম শাহাদাৎ বার্ষিকী পালন করা হয়েছে। শুক্রবার (৫ মে) সকালে এ উপলক্ষে পিরোজপুরের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের শহীদ পুলিশ স্মৃতিস্তম্ভে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাঈদুর রহমান শ্রদ্ধাঞ্জলি জনান। পরে ফয়জুর রহমান আহমেদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) শেখ মোস্তাফিজুর রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা গৌতম নারায়ন রায় চৌধুরী সহ জেলা পুলিশের অন্যান্য সদস্যরা।

১৯৭১ সালের এই দিনে পিরোজপুরের তৎকালীন মহাকুমা পুলিশ অফিসার (SDPO) সাহিত্য সুধাকর ফয়জুর রহমান আহমেদ পাক বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শাহাদাৎ বরণ করেন। ফয়জুুর রহমান আহমেদ বাংলাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ, সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং কার্টুনিস্ট আহসান হাবিব-এর মতো গুণী সন্তানদের পিতা।

ফয়জুর রহমান আহমেদ ১৯২১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থানার কুতুবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৩৯ সালে কিশোরগঞ্জ হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৪১ সালে কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে তিনি ১৯৪৩ সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবনে তিনি ১৯৪৬ সালে পুলিশ বিভাগে সাব-ইন্সপেক্টর পদে যোগদান করেন। চাকরিজীবনে বিভিন্ন পদে তিনি সিলেট, পঞ্চগড়, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম, বগুড়া ও কুমিল্লায় এবং সাব-ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার হিসেবে পিরোজপুরে দায়িত্ব পালন করেন। হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল কিংবা আহসান হাবীব—তাঁর কোনো পুত্রই তখনো বিখ্যাত হয়ে ওঠেননি।

ফয়জুর রহমান আহমেদ পিরোজপুরে কর্মরত অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। তিনি নিজের ও তাঁর পরিবারের জীবন বিপন্ন জেনেও মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র, গোলাবারুদ ও যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করেন। ওই সময় তিনি পিরোজপুরের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ২৫ মার্চের কালরাতে পাক-হানাদার বাহিনীর আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে খবর সংগ্রহ করে পিরোজপুরের মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব পরিচালনায় সক্রিয় উদ্যোগ নেন। যুদ্ধ শুরু হলে অস্ত্রাগারে সংরক্ষিত অস্ত্র সরবরাহ করে প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তোলেন এবং ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন। একাত্তরের ৪ মে পাক হানাদার বাহিনী পিরোজপুর শহর দখল করে নিলে সে সময় ফয়জুর রহমান আহমেদ পিরোজপুরের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে অবস্থানরত তাঁর পরিবারবর্গের সঙ্গে দেখা করতে যান। পরদিন অর্থাৎ ৫ মে পিরোজপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার চিঠি পেয়ে তিনি কর্মস্থলে এসে পৌঁছলে পাক-বাহিনী তাঁকে বন্দি করে এবং বলেশ্বর নদীর তীরে নিয়ে গুলি করে হত্যার পর তাঁর মৃতদেহ নদীতে ফেলে দেয়। তিন দিন পরে স্থানীয় এক কৃষক  তার মৃত দেহ নদীতে ভাসতে দেখে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁর মৃতদেহ নদী থেকে তুলে নদীতীরে সমাহিত করে এবং পরিচয়ের জন্য তার বুট জোড়া নিজের কাছে রেখে দেয়। স্বাধীনতার পর তাঁর মৃতদেহ পূর্ণ মর্যাদায় ওই কবর থেকে পিরোজপুর কবরস্থানে স্থানান্তর করা হয়।

পিরোজপুর মহকুমা ট্রেজারীর অর্থ ও অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে যাওয়ার সাথে পিরোজপুরে তৎকালীন এসডিপিও ফয়জুর রহমানের সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়ে ছিল পাক বাহিনী। ৭১'র ২ মে ট্রেজারীর টাকা মুক্তিযোদ্ধারা নিয়ে গেলে ৪ মে পিরোজপুর শহর পাক বাহিনী দখলে নেয়। এর আগেই হুমায়ূন আহমেদ মা ও ভাই-বোনদের নিয়ে প্রথমে নাজিরপুর থানায় ও পরে নাজিরপুরের বাবলা গ্রামে জনৈক মোবারক খানের বাড়ীতে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন। এই বাড়ীতে মে'র ৩ তারিখে ফয়জুর রহমান তাঁর পরিবারবর্গের সঙ্গে দেখা করতে যান। শহীদ ফয়জুর রহমান বিয়ে করেন মোহনগঞ্জ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী শেখবাড়ীতে। তার স্ত্রী রত্নগর্ভা প্রয়াত আয়শা ফয়েজ, যিনি বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য প্রথম মামলা করেছিলেন। যদিও তখন তাঁর মামলা কেউই নিতে চায়নি। হ‍ুমায়ূন আহমেদ তাঁর মায়ের সেই মামলা করার প্রচেষ্টা দেখে ‘জলিল সাহেবের পিটিশন’ নামক একটি অসাধারণ গল্প লিখেছেন।

জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসরকারি সম্মাননা পদক স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর) দেয়া হয়। ফয়জুর রহমানের মেয়ে সুফিয়া হায়দার শেফুর হাতে এ পদক তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়ি ইউনিয়নের কলসাটি গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে বঙ্গবাজার। বঙ্গবাজার থেকে ১ কিলোমিটার দক্ষিনে তার পৈতৃক নিবাস কুতুবপুর গ্রামের সড়কটির নামকরন করা হয় শহীদ ফয়জুর রহমান সড়ক। পিরোজপুরেও একটি সড়কের নামকরন করা হয় তার নামে। ২০০০ সালে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ তার স্মরনে দুই টাকা মূল্যের একটি ডাক টিকেট প্রকাশ করে।