নাবিলা রহমান (ছদ্মনাম)। নতুন বিয়ের মাস কয়েক হতে চলেছে। প্রবাসী বাবা মোটামুটি চলনসই আয়ের মধ্যেই উপযুক্ত বয়সে উপযুক্ত পাত্র দেখে দিয়েছিলেন মেয়ের বিয়ে। কিন্তু কে জানতো রহমত-বরকতের মাস মাহে রমজান শান্তির পয়গাম নিয়ে আসলেও নাবিলার জীবনে নেমে আসবে অসহনীয় কষ্ট! রমজানের দিন কয়েক আগে শ্বশুর বাড়ি থেকে নাবিলাকে বলা হয় ইফতার সামগ্রী দেওয়ার কথা। সাধ্যমতো নাবিলার বাবা প্রয়োজনীয় পন্যসামগ্রি পাঠালেও কম পড়ার অযুহাতে শ্বশুর বাড়িতে লাঞ্চিত হতে হয় তাকে।
শুধু নাবিলা নয়। এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় দেশের নববিবাহিতা অনেক নববধূকে। কোনো কোনো সময় লাঞ্চনার বাইরে গিয়ে সহ্য করতে হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। এই কষ্টের শেষ কোথায়? বা এই অপসংস্কৃতি বন্ধে কি করা দরকার? -এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই কারো কাছে। আর কত নির্যাতনের শিকার হলে বন্ধ হবে এই অপসংস্কৃতি চর্চা সে বিষয়েও অনিশ্চিত আমরা।
ধৈর্য্য, প্রজ্ঞা, সংযমের মাস মাহে রমজান। মুসলিম জাতীয় জীবনে এই মাসটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। স্বীয় পাপ, অপরাধসহ যাবতীয় অনৈতিক কাজ থেকে বিরত থাকার অঙ্গিকার করে মহান রবের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করার উত্তম সময় এ মাস। তিন স্তরে বিভক্ত এ মাসকে (রহমত,বরকত,নাজাত) সৎ চরিত্র গঠন ও নৈতিক পন্থানুসরণ-চর্চার মাসও বলা চলে। রহমত-বরকতের মাস হওয়া স্বত্বেও এ মাস এলেই পুরো দেশ জুড়ে চলে একটি অপসংস্কৃতির চর্চা। আর সেটি হলো, নব বিবাহিতা মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে ইফতার সামগ্রী, নতুন জামা-জুতোসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দেওয়ার সংস্কৃতি। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে অনেক বিত্তশালী মানুষ এটিকে ভালো ও আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে দেখলেও ক্ষেত্র ভেদে এটি কোনো স্বাভাবিক বিষয় নয়।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ দরিদ্র পীড়িত, নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণিভুক্ত। এসব পরিবারে উপার্জনক্ষম সদস্য একের বেশি নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুজন হলেও পন্যমূল্য উর্ধগতির এ সময়ে পুরো পরিবারের ব্যয়ভার বহন করতে পোহাতে হয় অসহনীয় কষ্ট। আবার রমজান এলে এসব পরিবারগুলোর মধ্যে যাদের কন্যা সন্তানের নতুন বিয়ে হয়েছে সেসব পরিবারকে পড়তে হয় চরম বেকায়দায়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আর্থিক টানাপোড়েন মোকাবেলা করে এই অপসংস্কৃতির চর্চা চললেও এবার তা হয়ে দাঁড়িয়েছে গলার কাঁটা। বিগত বছরের তুলনায় এবার পুরো দেশে বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল পন্যের দাম। উচ্চমূল্যে এসব পন্য কিনে নিজেদের চাহিদা মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছেন দেশের নিম্নআয়ের কোটি মানুষ। বাজারে চাল,ডাল,তেল,আটা-আলুসহ বেড়েছে সকল পন্যের দাম। উদ্ভুত এই পরিস্থিতিতে ভোগব্যয় আকাশ ছোঁয়ার প্রতিযোগিতায় নামলেও প্রসারিত হয়নি মানুষের আয়ের উৎস। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এর জন্য কিছুটা দায়ী হলেও দাম বৃদ্ধির পেছনে প্রধান ভূমিকা দেশের সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের। কমানো যাচ্ছে না সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য। তার উপর মাহে রমজান আসতে না আসতেই শুরু হয়েছে এই অপসংস্কৃতির চর্চা। চরম আর্থিক কষ্ট সহ্য করেও দু'কথা শোনা এবং নির্যাতন থেকে নববিবাহিতা মেয়েদের বাঁচানোর জন্য সংগ্রাম করছেন দেশের হাজারো বাবা। যেখানে দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত উর্ধগতির সময়ে পারিবারিক ভাবে বেহাল দশা পার করছে দেশের কোটি মানুষ সেখানে নিঃসন্দেহে এটি অপসংস্কৃতি ছাড়া কিছুই নয়। এটি যেমন বাঙালি সংস্কৃতির অংশ নয় ঠিক তেমনই ইসলামও এটিকে সমর্থন করে না। তাই এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান জরুরি। শুধু মাহে রমজান নয় ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহাকে (বকরী ঈদ) কেন্দ্র করেও তৈরি হয় এমন পরিস্থিতি। আবার ঈদ কিংবা উৎসব ছাড়াও বিভিন্ন সময় মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে ঋণ করে উপহার পাঠাতে দেখা যায় অনেক পরিবারকে।
দেশে চলমান এই অপসংস্কৃতি বন্ধে সরকারি উদ্যোগে জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি প্রয়োজন বোধে এ অপসংস্কৃতির চর্চা করে এমন ব্যাক্তি-পরিবারকে চিহ্নিত করে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। অপসংস্কৃতির এই চর্চা বন্ধে জনগন, সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে।