ফ্রিডম বাংলা নিউজ

শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪ |

EN

গার্মেন্টস পণ্য চোরচক্রের দলনেতা কোটিপতি

নিজস্ব প্রতিবেদক | আপডেট: রবিবার, ফেব্রুয়ারী ৫, ২০২৩

গার্মেন্টস পণ্য চোরচক্রের দলনেতা কোটিপতি
শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দা (৫২)। গার্মেন্টস পণ্য চোরচক্রের মাস্টার মাইন্ড। প্রায় দেড় যুগ ধরে তিনি ৪০-৫০ জনের একটি অপরাধচক্র চালিয়ে বনে গেছেন কোটিপতি। এই সময়ে চক্রটি শতকোটি টাকার রপ্তানিযোগ্য গার্মেন্টস পণ্য চুরি করেছে। 

শুক্রবার র‌্যাবের হাতে ধরা পড়েছেন শাহেদ ও তার তিন সহযোগী। 

র‌্যাব জানিয়েছে, গার্মেন্টস পণ্য চুরির টাকায় শাহেদ মৌলভীবাজার শহরে প্রায় ২০ কোটি টাকা মূল্যের একটি বাড়ি করেছেন। এছাড়া জেলার দুর্লভপুরে প্রায় ২০ একর জমিতে মাছের ঘেরসহ বিশাল দুটি হাঁস-মুরগির খামারও রয়েছে তার। বর্তমানে তার চারটি কাভার্ডভ্যান রয়েছে। তার সহযোগীদের রয়েছে আরও ১৫টি কাভার্ডভ্যান। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ১৭-১৮টি গার্মেন্টস পণ্য চুরির মামলা রয়েছে। যার অধিকাংশ মামলায় তিনি কারাভোগ করেছেন। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে আদালতে ছয়টি মামলার বিচারকার্য চলছে।

শনিবার রাজধানীর কাওরানবাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানায় র‌্যাব। গ্রেফতার অপর তিনজন হলেন- ইমরাত হোসেন সজল, শাহজাহান ওরফে রাসেল ওরফে আরিফ ও হৃদয়। শুক্রবার মৌলভীবাজার, গোপালগঞ্জ ও ঢাকার আশপাশের এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে একটি কাভার্ডভ্যানসহ ব্রাজিলে রপ্তানি করা পণ্যের স্যাম্পল ও তিনটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়।

র‌্যাব বলছে, শাহেদ ১৯৯৬ সালে চট্টগ্রামে দুটি ট্রাক কিনে লোকাল ব্যবসা শুরু করে। ২০০৪ সালে ট্রাক দুটি বিক্রি করে চারটি কাভার্ডভ্যান কিনে গার্মেন্টস পণ্য পরিবহন শুরু করে। সে কাভার্ডভ্যানের চালক ও হেলপারদের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের সহায়তায় গার্মেন্টস পণ্য চুরির একটি চক্র তৈরি করে। এরপর থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সে সশরীরে উপস্থিত থেকে গার্মেন্টস পণ্য চুরি করত। তবে এরপর থেকে শাহেদ আড়ালে থেকে চুরির কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। প্রতিটি চুরির ঘটনায় আয় করা অর্থের সর্বোচ্চ অংশ পেত সে। 

শনিবার সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ২০২২ সালের ২৯ অক্টোবর গাজীপুরের কোনাবাড়ির একটি তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এক লাখ ২৫ হাজার ডলারের বেশি মূল্যের সোয়েটারের একটি চালান চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ব্রাজিলে পাঠায়। ৮৯৮ কার্টনভর্তি সোয়েটার চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানোর পর বন্দর থেকে ব্রাজিলের উদ্দেশ্যে মালামাল নিয়ে রওয়ানা দেয় জাহাজ। এরপর ক্রেতা পুরো অর্থ পরিশোধ করে দেন। তবে ৬ জানুয়ারি ব্রাজিলের ক্রেতা একটি ভিডিও পাঠান। 

‘সেখানে দেখা যায়, কিছু কার্টন সম্পূর্ণ খালি এবং অনেক কার্টন থেকে পণ্য খোয়া গেছে। পরে চুরি হওয়া গার্মেন্টস পণ্যের সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা হিসেবে পরিশোধ করতে হয় মালিকপক্ষকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মালিকপক্ষ ২ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের গাছা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। এর পরই চোর চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারসহ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায় র‌্যাব। এরই ধারাবাহিকতায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শুক্রবার রাতে মৌলভীবাজার, গোপালগঞ্জ ও ঢাকার আশপাশের এলাকায় অভিযান চালিয়ে র‌্যাব চারজনকে গ্রেফতার করে।’ 

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাব জানতে পারে, শাহেদের এই চক্রে রয়েছে অসাধু ড্রাইভার, হেলপার, গোডাউন মালিক, গোডাউন এলাকার আশ্রয়দাতা, অত্যন্ত দক্ষ কুলি সর্দারসহ একদল লেবার। তারা গার্মেন্টস পণ্য পরিবহণের সঙ্গে সম্পৃক্ত কাভার্ডভ্যানের চালক ও সহকারীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে এবং অল্প সময়ে বেশি অর্থ লাভের প্রলোভন দেখিয়ে গার্মেন্টস পণ্য চুরির কাজে উৎসাহিত করে। প্রতিটি চুরির আগে গাড়ি চালকদের মাধ্যমে বিদেশে রপ্তানি করা গার্মেন্টস পণ্যের স্যাম্পল নিয়ে চোরাইকৃত পণ্যের সম্ভাব্য বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করত তারা। 

চুরির জন্য নির্ধারিত গার্মেন্টস পণ্যের আনুমানিক মূল্য ১২-১৫ লাখ টাকা হলেই তারা চুরি কার্যক্রম পরিচালিত করত। তবে এই মূল্যের কম হলে তারা চুরি করত না। এই টাকা থেকে কাভার্ডভ্যানের চালক ৩০ হাজার, সহকারী ২০ হাজার, গোডাউনের মালিক ৫০ হাজার, গোডাউন এলাকার শেলটার পার্টি ৬০ হাজার, কার্টুন প্যাকেজিং এক্সপার্ট ১০ হাজার, অন্য শ্রমিকদের ২ থেকে ৩ হাজার টাকা দেওয়া হতো। আর বাকি টাকা তাদের গ্রুপের মধ্যে অবস্থান অনুযায়ী বণ্টন করা হতো।

চালক ও তার সহকারী পণ্যবাহী কাভার্ডভ্যানটি নির্দিষ্ট গোডাউনে নিয়ে গেলে চক্রের অন্য সদস্যরা কার্টন কেটে গার্মেন্টস পণ্যগুলো আলাদা করে রাখত। প্রথমত তারা ১০ পিসের কার্টন থেকে চার পিস এবং ২০ পিসের কার্টন থেকে ৬-৮ পিস গার্মেন্টস পণ্য সরিয়ে রেখে পুনরায় কার্টনগুলো প্যাকেজিং করে দ্রুত কাভার্ডভ্যানে লোড করে বন্দরের উদ্দেশে রওনা দিত। পরবর্তীতে চক্রের অন্য সদস্যরা চোরাই পণ্যগুলো তাদের নিজস্ব পিকআপ বা কাভার্ডভ্যানে করে অন্য একটি গোডাউনে এক থেকে দেড় মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করত। ট্রান্সপোর্টের মালামাল যখন বিভিন্ন দেশে রপ্তানির উদ্দেশ্যে বন্দর থেকে দেশের বাইরে চলে যেত তখন তারা চোরাই পণ্যগুলো রাজধানীর উত্তরাসহ বিভিন্ন বায়িং হাউজের অসাধু মালিকদের কাছে বিক্রি করে দিত।

র‌্যাব জানায়, ব্রাজিলে রপ্তানি করা পণ্য চুরির ঘটনাও শাহেদের নির্দেশে সংঘটিত হয়। গত বছর ২৯ অক্টোবর গাজীপুর থেকে গার্মেন্টস পণ্য কাভার্ডভ্যানে লোড করে সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশে যাত্রা করে। কাভার্ডভ্যানে পণ্য লোডের পর গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ চালক শাহজাহানের কাছে নমুনা হিসেবে কিছু সোয়েটার দেয়। চালক শাহজাহান নমুনা পাওয়ার পর ছবি তুলে মোবাইলের মাধ্যমে মূলহোতা শাহেদের কাছে পাঠায়। শাহেদ নমুনা পেয়ে চুরির ঘটনা বাস্তবায়নকারী আসামি তাওহীদুল ওরফে কাওছার ওরফে বড় কাওছারের কাছে পাঠায় এবং পণ্যের গুণগত মান ও বাজারমূল্য বিবেচনা করে এই চালানটিতে চুরির নির্দেশ দেয়। মাস্টারমাইন্ডের নির্দেশ মোতাবেক কাওছার চালকের সঙ্গে যোগাযোগ করে চুরির মূল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে।