বিয়ে ও তালাক নিয়ে জাল-জালিয়াতি করে বেকায়দায় পড়ে গেছেন ক্রিকেটার নাসির হোসাইন ও সৌদিয়া এয়ারলাইনসের কেবিন ক্রু তামিমা সুলতানা। এই অনৈতিক কাজে পুরোপুরি সহযোগিতা করে তামিমার মা সুমী আক্তারেরও একই দশা। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) গভীর অনুসন্ধানের পর আদালতে জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদন বিশ্লেষণে নাসির-তামিমাদের দেওয়া ডকুমেন্টে ব্যাপক গড়মিল পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে, ‘তালাকের নোটিশ’ ও পুলিশের কাছে জমা দেওয়া ‘ভাড়াটিয়া নিবন্ধন ফরমে’ রয়েছে অস্বাভাবিক রকমের জালিয়াতির তথ্য।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাস্তবিকভাবে তালাক না দিয়েই স্বামী রাকিবের সঙ্গে তামিমা ভয়ঙ্কর জালিয়াতি করেছেন। যার ফলে ক্রিকেটার নাসিরের সঙ্গে ঢাকঢোল পিটিয়ে তামিমার যে বিয়ে হয়েছে সেটি অবৈধ। আর এই অবৈধ বিয়ের সম্পর্কে জড়াতে তারা জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া তালাকনামা তৈরি করেছেন। যে কারণে তাদেরকে নিতে হয়েছে নানান মিথ্যার আশ্রয়। মূলত সত্যকে চাপা দিতে গিয়েই ক্রিকেটার নাসির, কেবিন ক্রু তামিমা ও তার মা সুমি আক্তার এখন হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। এ-সংক্রান্ত পর্যাপ্ত ডকুমেন্ট আরটিভি নিউজের হাতে রয়েছে।
ডকুমেন্ট ও তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী নাসির-তামিমার যত জালিয়াতি-
তালাকের নোটিশ ও ভাড়াটিয়া নিবন্ধন ফরমের তারিখে গড়মিল:
রাকিবের সঙ্গে তালাক হয়েছে, এমনটা প্রমাণ করতে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে ‘স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে তালাকের নোটিস’-এর কপি সাংবাদিকদের হাতে দেওয়া হয়েছে। একইভাবে তদন্ত সংস্থা পিবিআইর কাছেও নাসির-তামিমা যৌথভাবে সেই তালাকের নোটিসের কপি প্রদান করেন। যেটিতে দেখা যায়- ২০১৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর রাকিব হাসানকে ‘তালাক’ ঘোষণা দিয়েছেন তামিমা সুলতানা। যে ডকুমেন্টে তামিমার বাসার ঠিকানা উল্লেখ রয়েছে- বাসা নং-৫৩, রোড নং-০৩, উত্তরা সেক্টর-০৫।
অন্যদিকে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) উত্তরা পশ্চিম থানায় নথিভুক্ত করা ‘ভাড়াটিয়া নিবন্ধন ফরমে’ দেখা যায়, তামিমার বাসার ঠিকানা উল্লেখ রয়েছে, বাসা নং-৫৮ এর ষষ্ঠ তলা, রোড নং-০৩, উত্তরা সেক্টর-০৫। যে বাসায় তারা এখনও ভাড়া থাকছেন। আরটিভি নিউজের হাতে প্রমাণ রয়েছে, ওই ‘ভাড়াটিয়া নিবন্ধন ফরমটি’ তামিমার মা সুমি আক্তার নিজ হাতেই লিখে ২০১৯ সালের ১৬ জুন সংশ্লিষ্ট থানার বিট পুলিশের হাতে জমা দিয়েছিলেন। ফরমটিতে উল্লেখ রয়েছে, তারা এই ৫৮ নম্বর বাসায় ২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে ভাড়া থাকছেন। বাড়িটির মালিকের নাম রোমন। এই বাড়িতে তাদের সঙ্গে সুমি আক্তারের ভাগ্নে পরিচয় দেওয়া ৩৮ বছর বয়সী বাবু এবং ভাগ্নি পরিচয় দেওয়া ৪০ বছর বয়সী মিলি নামের দুই জনও থাকছেন। তবে তারা আসলেই সুমী আক্তারে ভাগ্নে-ভাগ্নি কি না, সেটি এখনও নিশ্চিত নয়।
ভাড়াটিয়া নিবন্ধনের একই ফরমে উল্লেখ রয়েছে, তারা বর্তমান বাসায় আসার আগে উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টরের ০৯ নম্বর রোডের ১৪ নম্বর বাড়ির চতুর্থ তলায় ১৩ হাজার টাকায় ভাড়া থাকতেন। যে বাড়িটির মালিকের নাম আজাদ খন্দকার।
এমন তথ্য-প্রমাণে প্রশ্ন উঠেছে- তামিমা কী করে জানতেন আগামী ৬ মাস ৯ দিন পর তিনি ১৪ নম্বর সেক্টরের বাসা ছেড়ে ১ জুলাই ২০১৭ তারিখে ৫ নম্বর সেক্টরের বাসায় উঠবেন? আরও প্রশ্ন উঠেছে, যেখানে তামিমার মা সুমী আক্তারের হাতে পূরণ করা ‘ভাড়াটিয়া নিবন্ধন ফরম’ বলছে, বর্তমান ৫ নম্বর সেক্টরের ৫৮ নম্বর বাসায় আসার আগে তারা ১৪ নম্বর সেক্টরের ১৪ নম্বর বাসায় ভাড়া থাকতেন। তাহলে কেমন করে তামিমা গত ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে ০৫ নম্বর সেক্টরের ৫৩ নম্বর বাড়ি থেকে তালাকের নোটিস পাঠালেন? অথচ পিবিআই তদন্ত করে প্রমাণ পেয়েছে, তামিমারা কখনই এই ৫৩ নম্বর বাড়িতে ছিলেন না। এই ঠিকানাটি তামিমার বাসা হিসেবে একেবারেই ভুয়া।
রাকিবের আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, সত্য ঢাকতে গিয়ে নাসির-তামিমা ও তার মা সুমী আক্তার ভয়ঙ্কর জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন; যার অকাট্য প্রমাণ সংশ্লিষ্ট মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা পিবিআইর প্রতিবেদনের উঠে এসেছে। এ বিষয়ে এবার আদালতই বিচারিক ব্যবস্থা নেবেন বলে আশা করছি।
তিনি আরও বলেন, ক্রিকেটার নাসির হোসাইন এবং কেবিন ক্রু তামিমা সুলতানার বিয়ে বৈধ নয় বলে আদালতে পিবিআই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে। যথাযথভাবে তালাক না হওয়ায় তামিমা সুলতানা এখন পর্যন্ত ব্যবসায়ী রাকিব হাসানের স্ত্রী। ফলে, নাসির-তামিমার বিয়ে বৈধ হিসেবে গৃহীত হবে না। নাসির ও তামিমার বিরুদ্ধে রাকিব হাসানের দায়ের করা মামলায় গত ৩০ সেপ্টেম্বর আদালতের কাছে অভিযোগপত্র দাখিল করেছিলো পিবিআই।
ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ক্রিকেটার নাসির হোসাইন, বিতর্কিত বিয়ে করে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত থাকা নাসিরের স্ত্রী পরিচয় দেয়া তামিমা সুলতানা ও তার মা সুমী আক্তারকে আগামী ৩১ অক্টোবর আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকা মহানগর হাকিম মোহাম্মদ জসীমের আদালত।
তালাক জালিয়াতির জন্য ঠিকানা লুকোচুরির বিষয়ে পিবিআইর তদন্ত প্রতিবেদনের চৌম্বকীয় অংশ নিচে তুলে ধরা হলো-
সেই দুই বাসার তথ্য-প্রমাণে রাকিব-তামিমা একসাথে ছিলেন
২২/০৪/২০১৭ তারিখে বিবাহ ও তালাক রেজিস্টার পরিচয় দেয়া ‘কাজী’ জসিম উদ্দিন সুমি আক্তারকে তার হাতে সবুজ রঙের লিখিত কাগজ দিয়ে বলে তার মেয়ের তালাক কার্যকরী হয়েছে। উপরোক্ত বক্তব্যের বিষয়ে আমি তদন্তকালীন সময়ে জানতে পারি যে, বাদী রাকিব হাসান এবং বিবাদী তামিমা সুলতানা ও তার পরিবারসহ ২৪/১২/২০১৪ তারিখে বাসা নং ১৪, রোড নং ০৯, সেক্টর ১৪ উত্তরাতে ১৩ হাজার টাকা ভাড়ায় ৪র্থ তলায় উত্তর পার্শ্বে ফ্লাটে ০১/০৭/২০১৭ তারিখ পর্যন্ত ভাড়া ছিলেন।
এবং ০১/০৭/২০১৭ তারিখে তামিমাদের নতুন বাসা নং-৫৮, রোড নং-০৩, সেক্টর-০৫ উত্তরাতে ওঠেন।
অর্থাৎ বিবাদী কর্তৃক বাদীকে তালাকের সময় ২৩/১২/২০১৬ তারিখ ও পরবর্তীতে ২২/০৪/২০১৭ তারিখে ২৭(১)(ঘ) অনুযায়ী তালাক তফউইজ রকমের তালাকের রেজিস্ট্রারী বহিতে রেজিস্ট্রিভুক্ত করার সময় সাক্ষ্য প্রমাণে বাসা নং-১৪, রোড নং-০৯, সেক্টর-১৪ উত্তরাতে ছিল।
থানায় রক্ষিত ভাড়াটিয়ার নিবন্ধন ফরম তথ্য বিবরণীতে দেখা যায়- বিবাদীর মা সুমী আক্তার, স্বামী শহিদুর রহমান ০১/০৭/২০১৭ তারিখে বাসা নং-৫৮, রোড নং-০৩, সেক্টর-০৫ উত্তরাতে বাসা ভাড়া নিয়ে ওঠে।
তামিমাদের আগের বাসা নং-১৪, রোড নং-০৯, সেক্টর-১৪ উত্তরা’র বর্তমান মালিকের সাক্ষ্য এবং বর্তমান বাসা নং-৫৮, রোড নং-০৩, সেক্টর-০৫ উত্তরা’র মালিকের সাক্ষ্য এবং উত্তরা পশ্চিম থানায় রক্ষিত সুমী আক্তারের নিজ হাতে লেখা ভাড়াটিয়া নিবন্ধন ফরম তথ্য বিবরণী মতে- বিবাদী তামিমা সুলতানা ও তার পরিবার মামলার বাদী রাকিব হাসানও একই সাথে ০১/০৭/২০১৭ তারিখে ০৫ নম্বর সেক্টরের ৩ রোডের ৫৮ নম্বর বাড়িতে ওঠে।
অর্থাৎ বিবাদী তামিমা সুলতানা কর্তৃক বাদীকে স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে তালাকের নোটিশ ২৩/১২/২০১৬ তারিখ প্রদান করার সময় বর্ণিত তালাকের নোটিশে উল্লেখিত ঠিকানা বাড়ী নং-৫৬, রোড নং-০৩, সেক্টর-০৫ থানা উত্তরা পশ্চিম ঢাকায় বাদী বা বিবাদীগন কখনই ছিলেন না।
পোস্টাল জালিয়াতি
পিবিআই তদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে, রাকিবের গ্রামের বাড়ির ঠিকানা- ঝালকাঠি জেলার নলছিটি থানার নিশাদনগর পোষ্ট অফিসের সাবপোষ্ট মাস্টার মোহাম্মদ আলী শামিমের জবানবন্দিতে এবং ঢাকা-১০০০ এর ডেপুটি পোষ্টমাস্টার মোহাম্মদ মাসুদ পারভেজের দেয়া প্রতিবেদনে জানা যায়- ২৬/১২/২০১৬ তারিখে রাকিবের গ্রামের বাড়ির ঠিকানায় তালাকের নোটিশ প্রেরণের সত্যতা পাওয়া যায়নি।
এসব হ-য-ব-র-ল জালিয়াতির বিষয়ে জানতে তামিমার মা সুমী আক্তারের ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।