মেট্রোরেলকে গণপরিবহন হিসেবে কার্যকর করতে ৩০ শতাংশ ভাড়া কমানোর সুপারিশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি মেট্রোস্টেশনের সঙ্গে বহুমাধ্যমভিত্তিক পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি বলে মত দিয়েছেন তারা।
সোমবার (২৬ ডিসেম্বর) অনলাইনে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) আয়োজিত ‘রাজধানীর টেকসই পরিকল্পনায় মেট্রোরেল : প্রেক্ষিত ও করণীয়’ শীর্ষক ‘আইপিডি পরিকল্পনা ও উন্নয়ন পর্যালোচনা’ অনুষ্ঠানে বক্তারা এ মত দেন।
আলোচকরা বলেন, ঢাকার যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থায় মেট্রোরেলের সংযোজন তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে যদি সাধারণ গণমানুষের জন্য এটার ভাড়া সাশ্রয়ী এবং মেট্রো স্টেশনে আসা যাওয়ার পথকে সুগম করা হয়। মধ্যবিত্তরাই এই গণপরিবহন বেশি ব্যবহার করবে, তাই মেট্রোরেলের পর্যাপ্ত যাত্রীসংখ্যা নিশ্চিত করতে মেট্রোরেলের ভাড়া ৩০ শতাংশ কমানো দরকার এবং মেট্রোলাইনকে কেন্দ্র করে বহুমাধ্যমভিত্তিক সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন।
তারা আরও বলেন, মেট্রোস্টেশনগুলোর আশপাশে পথচারী চলাচল, বাস-প্যারা টানজিট-কমিউনিটি ভিত্তিক সার্ভিস, সিএনজি-রিকশা-ব্যক্তিগত গাড়ি প্রভৃতি বাহনগুলোর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ কীভাবে মেট্রোস্টেশনে আসবে বা স্টেশন থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে যাবে সে ব্যাপারে কার্যকর পরিকল্পনার মাধ্যমে মেট্রোরেলের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এ বছর মেট্রোরেলের উদ্বোধন করা হলেও আগামী বছর উত্তরা থেকে আগারগাঁও হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত এমআরটি ৬ লাইনের পুরোটা চালু হয়ে গেলে বিপুলসংখ্যক যাত্রীকে মেট্রোরেলের মাধ্যমে দ্রুত পরিবহন করা যাবে, যা নগরের পরিবহন ব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে। পাশাপাশি মেট্রোরেলকে সাধারণ জনগণের পরিবহন হিসেবে গড়ে তুলতে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও ন্যূনতম আয়শ্রেণি এবং ছাত্রদের জন্য ৫০ ভাগ ভাড়ার ব্যবস্থা করা এবং পাঁচ বছর পর্যন্ত বয়সীদের জন্য বিনা ভাড়ায় মেট্রো পরিবহনের ব্যবস্থা করার দাবি জানান তারা।
অনুষ্ঠানে আইপিডির নির্বাহী পরিচালক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তনের পাশাপাশি মেট্রোরেল ভূমি ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব রাখবে। মেট্রোরেলের কারণে স্টেশনের আশপাশের এলাকার ভূমি ব্যবহারের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে, যার আলামত ইতোমধ্যেই উত্তরা থেকে আগারগাঁও এলাকায় চোখে পড়ছে। মেট্রোরেলের কারণে এই এলাকার ভূমির মূল্য বেড়ে গেছে এবং নতুন নতুন আবাসন প্রকল্প তৈরি হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বৈশ্বিকভাবেই এ ধরনের রূপান্তর প্রক্রিয়ায় মেট্রোরেল হওয়ার আগে যে ধরনের এবং যে আয়শ্রেণির লোকেরা এসব এলাকায় ইতোপূর্বে বসবাস করত, তারা নতুন ও তুলনামূলক উঁচু আয়শ্রেণির মানুষ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়, নগর পরিকল্পনার ভাষায় যাকে বলে হয় ‘জেনট্রিফিকেশন’ বা বসবাসকারী জনসংখ্যার শ্রেণি পরিবর্তন। ফলে নগর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় সঠিক নীতি কৌশল প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও যথাযথ উন্নয়ন নজরদারি প্রয়োজন, যেন এই জেনিট্রিফিকেশন তুলনামূলকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং মেট্রোরেলের সুফল সব আয়শ্রেণির মানুষ পেতে পারে ও সার্বিক জনকল্যাণ নিশ্চিত করা যায়।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) উপদেষ্টা পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, মেট্রোরেল ঢাকাবাসীকে সুশৃংখল গণপরিবহনের নতুন স্বাদ এনে দেবে। মেট্রোরেলের আশপাশের পরিকল্পিত উন্নয়নের জন্য ছোট ছোট প্লট একত্রীকরণ বা ল্যান্ড কনসোলিডেশন করার উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ঢাকার শহরের অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে মেট্রোব্যবস্থা অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। তবে মেট্রোরেলকে কার্যকর করতে মেট্রোর পাশাপাশি সমন্বিত উপায়ে বাস সার্ভিস চালু করা এবং স্টেশনগুলোতে পর্যাপ্ত পদচারী সুবিধা ও গাড়ি পার্কিং সুবিধা রাখা প্রয়োজন। পাশাপাশি ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ করতে ঢাকার সঙ্গে কাছাকাছি দূরত্বের আঞ্চলিক শহরগুলোর দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ এবং মেট্রোরেল সংশ্লিষ্ট ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট (টিওডি) প্রকল্পের পরামর্শক ড. আফসানা হক বলেন, মেট্রোরেলের আশপাশের ভূমি ব্যবহার এবং স্টেশন প্লাজাকেন্দ্রিক পরিকল্পনার যে উদ্যোগ এখন নেওয়া হচ্ছে তা কয়েক বছর আগেই শুরু করা প্রয়োজন ছিল। এক্ষেত্রে সন্নিহিত নেইবারহুড বা পাড়া-মহল্লার বৈশিষ্ট্য ও ধরন অনুযায়ী স্টেশনগুলোর ডিজাইনে বৈচিত্র্য ও ভিন্নতা আনা দরকার।
আইপিডি অনুষ্ঠানে আরও যুক্ত ছিলেন আইপিডি পরিচালক পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম, উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ রেদওয়ানুর রহমান, ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের ডেপুটি আরবান প্ল্যানার মিজানুর রহমান, চটগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সহকারী অধ্যাপক পরিকল্পনাবিদ এটিএম শাহজাহান, যোগাযোগ ও ভূমি ব্যবহার বিশেষজ্ঞ আসাদুজ্জামান প্রমুখ।