গ্যাস সংকটের কারণে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় চুলা জ্বলছে না। একই পরিস্থিতি শিল্পে। গ্যাসের অভাবে স্বাভাবিক সময়ের মতো কারখানা চালানো যাচ্ছে না, কমছে শিল্পের উৎপাদন। তৈরি হয়েছে বিদ্যুতের ঘাটতি।
প্রায় আড়াই দশক আগের কথা, যখন বলা হয়েছিল ‘বাংলাদেশ প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর ভাসছে’। অর্থাৎ সোজা বাংলায় দেশের খনিগুলোতে মজুত থাকা গ্যাসের পরিমাণ এত বিপুল যে তার ওপর নির্ভর করে দেশ নিজে চুলায় দেয়া কিংবা গাড়ি চালানো কিংবা শিল্প-কারখানায় গ্যাস দিয়ে রপ্তানিও করতে পারে।
তার দেড় দশকের মধ্যেই বাংলাদেশকে গ্যাস আমদানি শুরু করতে হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে গ্যাসের মজুত আসলে কত আছে? আর সে গ্যাস দিয়ে কতদিন চলা সম্ভব হবে?
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান হাইড্রোকার্বন ইউনিটের মহাপরিচালক আবুল খায়ের মোহাম্মদ আমিনুর রহমান বলেছেন, এই মুহূর্তে দেশে আবিষ্কৃত গ্যাসের পরিমাণ মোট ২৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট বা টিসিএফের চাইতে কিছু বেশি।
তিনি বলেন, ‘আবিষ্কৃত ২৮ টিসিএফের মধ্যে ১৯৬৫ সালে আবিষ্কার হওয়া গ্যাসও আছে। কিন্তু যেহেতু প্রতিদিনই আমরা গ্যাস খরচ করছি, সে কারণে খরচ হওয়া অংশ বাদ আমাদের মজুতের পরিমাণ নয় দশমিক শূন্য ছয় টিসিএফ।’
আবিষ্কৃত গ্যাসের পরিমাণ নির্ধারণের বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আবুল খায়ের মোহাম্মদ আমিনুর রহমান বলেন, কূপ খনন করার পর সিসমিক জরিপের ফল এবং সেখানকার গ্যাসের চাপের ওপর নির্ভর করে ওই কূপে গ্যাসের মোট পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়।
আবিষ্কৃত গ্যাসের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে মূলত তিন ধরণের মজু্ত হিসাব হয়-প্রমাণিত মজুদ, উত্তোলনযোগ্য মজুদ এবং সম্ভাব্য মজ্ত।
সরকারি যে প্রতিষ্ঠানটি খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধান, উত্তোলন, পরিশোধন এবং বাজারজাত করার কাজ করে সেই পেট্রোবাংলার ওয়েবসাইটে দেয়া ২০২২ সালের জুলাই মাসের তথ্য বলছে, দেশে প্রমাণিত, উত্তোলন যোগ্য আর সম্ভাব্য মিলে মোট মজুতের পরিমাণ ৩০ দশমিক ১৩ টিসিএফ।
এর মধ্যে আবিষ্কৃত ২৮ টিসিএফ গ্যাসের মধ্যে এ পর্যন্ত ব্যবহার করা প্রাকৃতিক গ্যাসের পরিমাণ সাড়ে ১৯ টিসিএফের বেশি।
পেট্রোবাংলার ৩০শে অক্টোবরের দৈনিক গ্যাস উৎপাদন রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ২৮টি গ্যাসক্ষেত্রে মোট ৭০টি কূপ রয়েছে, এর মধ্যে ৬৯টি কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে।
এর মধ্যে দেশি প্রতিষ্ঠান বাপেক্স, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড বিজিএফসিএল এবং সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড এসজিএফএল গ্যাস উত্তোলন করছে। এর বাইরে দুইটি বহুজাতিক তেল কোম্পানি বা আইওসি শেভরন ও তাল্লো চারটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উৎপাদন করছে।
তবে এ বছরই বঙ্গোপসাগরের মহীসোপান এলাকায় বিপুল গ্যাসের মজুদের যে সম্ভাবনার তথ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিয়েছে, তা এখন পর্যন্ত মজুতের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
এদিকে, গ্যাস কূপগুলো থেকে প্রতিবছরই উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের পরিমাণ কমছে। হাইড্রোকার্বন ইউনিটের তথ্য থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালে দেশে প্রতিদিন ২ হাজার ৬৬৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হতো, যা ২০২১ সালে এসে ২ হাজার ৩৫২ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে যায়।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান হাইড্রোকার্বন ইউনিটের মহাপরিচালক আবুল খায়ের মোহাম্মদ আমিনুর রহমান এ সম্পর্কে
বিবিসি
বাংলাকে বলেছেন, বর্তমানে যে মজু্ত আছে তা দিয়ে আগামী নয় বছর চলা যাবে।
‘মানে যদি নতুন কোনো গ্যাসক্ষেত্র থেকে আর গ্যাস না পাওয়া যায়, তাহলে এই মজুদ দিয়ে আরও নয় বছর চলা যাবে। কিন্তু আগামী নয় বছরের মধ্যে নতুন গ্যাস উত্তোলন হবে না বা নতুন মজুত বাড়বে না, অতটা নৈরাশ্যবাদী আমরা নই, আর সে আশংকাও নাই। প্রতিবছরই নতুন কূপ যুক্ত হচ্ছে।’
এই মুহূর্তে বাপেক্সের মাধ্যমে নতুন গ্যাসক্ষেত্রের অনুসন্ধান চলছে। এবং এখন বাপেক্স ভোলা এবং সিলেট অঞ্চলে মোট ছয়টি নতুন কূপ খননের কাজ করছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
কিন্তু বাংলাদেশে বছরে এক ট্রিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস ব্যবহার হয়। বাংলাদেশে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ৩৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট, কিন্তু উৎপাদন হয় ২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। গ্যাসের মোট উৎপাদনের ৪০ শতাংশ যায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের পেছনে।