বিশ্বের অনেক শিল্পী, শিল্পপতি, সেলিব্রিটি আজকাল গাঁজা গ্রহণ করার কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করেন। এ ব্যক্তিদের মতে, গাঁজা তাদের সৃজনশীলতা বিকাশে সাহায্য করে। কিন্তু সত্যিই কি গাঁজা মানুষের সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করে? নাকি গাঁজা খেলে মানুষ মনে করে তারা সৃজনশীল হয়ে উঠছেন। এ বিষয়ক দুইটি গবেষণার ফলাফল জানিয়েছে হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ (এইচবিআর)।
গাঁজা গ্রহণ করলে সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়–হাল আমলের পপ-কালচারে এটি বেশ পোক্ত একটি ধারণা। স্টিভ জবস ও লেডি গাগার মতো বিখ্যাত ব্যক্তিরা গাঁজার গুণের কথা প্রকাশ্যে বর্ণনা করেছেন। তবে এখন পর্যন্ত বিশ্বের মাত্র অল্প কিছু দেশে গাঁজা গ্রহণ করা বৈধ।
কর্মক্ষেত্রে কর্মীর কাজের দক্ষতা, আচরণ ইত্যাদি নিয়ে এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা নানা গবেষণা করেছেন। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে গাঁজার প্রভাব নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার সংখ্যা বেশ সীমিত। আর তাই কোনো অফিসের কর্মীদের কাজের ওপর গাঁজা কী প্রভাব ফেলে তা জানতে গবেষণা করেছেন কয়েকজন বিজ্ঞানী।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন স্টেটে গাঁজার ব্যবহার বৈধ। এখানকার ৩০০ জন গাঁজা সেবনকারীর ওপর দুইটি গবেষণা পরিচালনা করা হয়। ওই সেবনকারীরা সপ্তাহে নিয়মতি গাঁজা গ্রহণ করেন। গাঁজার প্রভাব থাকা অবস্থায় তাদেরকে তাদের স্বাভাবিক পরিবেশে বিভিন্ন সৃজনশীল কাজ করতে দেন বিজ্ঞানীরা।
সৃজনশীলতা পরীক্ষার গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদেরকে একটি ইট দিয়ে সে ইটের যতগুলো সম্ভব সৃজনশীল ব্যবহারের তালিকা তৈরি করতে বলা হয়। এ ধরনের গবেষণায় এটি একটি প্রমিত পদ্ধতি। প্রথম গবেষণাটির ক্ষেত্রে এ বিজ্ঞানীরাও ওয়াশিংটনের গাঁজাসেবীদের একই কাজ করতে বলেন।
দ্বিতীয় গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের একটি কল্পিত পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়। তাদেরকে বলা হয়, তারা মনে করুক তারা একটি পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করছেন এবং একটি মিউজিক সংস্থা আরও বেশি আয় বাড়ানোর জন্য তাদের প্রতিষ্ঠানকে নিযুক্ত করেছে। এক্ষেত্রে অংশগ্রহণকারীদের আবারও সম্ভাব্য সবধরনের সৃজনশীল উপায়ের কথা ভাবতে বলেন বিজ্ঞানীরা।
এরপর বিজ্ঞানীরা গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের এবং একইসঙ্গে এক্সটার্নাল বিচারক, গবেষণা সহযোগী, ও বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের ওই সৃজনশীল আইডিয়াগুলোর বিচার করার ভার দেন।
তো কী খুঁজে পেলেন বিজ্ঞানীরা? দেখা গেছে, যেসব ব্যক্তি গাঁজা সেবন করে কাজ করেছেন, গড়পড়তা তারা বেশি সুখী, উৎফুল্ল, ও এক কথায় বলতে গেলে ভালো মেজাজে ছিলেন। এর ফলে দেখা গেছে, গাঁজা সেবন না করা অংশগ্রহণকারীদের তুলনায় তারা নিজেদের ও অন্যদের আইডিয়াকে বেশি সৃজনশীল হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন।
তবে যেসব স্বতন্ত্র বিচারক ওই আইডিয়াগুলো মূল্যায়ন করেছেন, তাদের চোখে গাঁজা সেবনকারী ও যারা সেবন করেন না, দুই দলের আইডিয়াগুলোর কোনোটিই সৃজনশীল ছিল না।
অর্থাৎ, এ দুই গবেষণার পর গবেষকেরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, গাঁজা কোনোভাবে মানুষের সৃজনশীলতার ওপর প্রভাব ফেলে না। তবে এটি মানুষের প্রফুল্লতা বাড়ায়। আর এ কারণেই আইডিয়ার সৃজনশীলতা নিয়ে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করেছিলেন নিত্য গাঁজাসেবীরা।
এর আগের ভিন্ন প্রসঙ্গে করা গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রফুল্লতা মানুষের সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করে। কারণ মন প্রফুল্ল থাকলে মানুষ আরও নমনীয় ও খোলা মনের হয়ে থাকেন। কিন্তু বর্তমান গবেষকদের দাবি, গাঁজা থেকে সৃষ্ট মানসিক প্রফুল্লতা সৃজনশীলতার ধারণা কেমন হতে পারে তা বাড়াতে সহায়তা করে, আদতে কাউকে সৃজনশীল করে না।
তবে বিজ্ঞানীরা একবাক্যে স্বীকার করেছেন, এ গবেষণায় গাঁজাকে কোনোভাবে দোষারোপ করা হয়নি। তাদের গবেষণা একইসঙ্গে এটাও প্রমাণ করেছে যে গাঁজা খেলে কারও যেমন সৃজনশীলতা বাড়ে না তেমনিভাবে এর প্রভাবে ব্যক্তির সৃজনশীল ক্ষমতায়ও কোনো নেতিবাচক পরিবর্তন হয় না। আর তাই, সৃজনশীল কাজ করতে হয় এমন কর্মীদের মাঝেমধ্যে গাঁজা খেলে তা-তে বিশেষ কোনো ক্ষতি হয় না।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন এ বিজ্ঞানীরা। যেহেতু গাঁজার প্রভাবে কম সৃজনশীল আইডিয়াকেও মানুষ সৃজনশীল হিসেবে মেনে নেয়, সেজন্য একটি অফিসে যেসব ম্যানেজারের দায়িত্ব নিজের বা কর্মীদের কাজের সৃজনশীলতা মাপা, তাদের গাঁজা সেবন না করে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
কর্মক্ষেত্রে যাদের কাজ সৃজনশীর আইডিয়া তৈরি করা, তাদের জন্য গাঁজা বাধ্যতামূলকভাবে নিষিদ্ধ না করারই পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বর্তমান গবেষণায়। আবার যেসব কাজে মাথা পরিষ্কার রেখে সৃজনশীলতা বিচার করতে হয়, সেসব ক্ষেত্রে কর্মীর ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে সম্মান জানিয়ে তাদেরকে 'সোবার' অবস্থায় থাকার জন্য উৎসাহিত করতে বলা হয়েছে প্রতিষ্ঠানকে।
তবে একথা স্মরণে রাখতে হবে যে গাঁজার প্রভাব নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা এখনো তুলনামূলকভাবে নতুন। এ ধরনের গবেষণা এখনো প্রাথমিক অবস্থায় রয়েছে। গাঁজা মানুষের দুশ্চিন্তা, বিষণ্ণতাসহ অন্যান্য মানসিক সমস্যা দূর করতে পারে কিনা, অতীতে এমন গবেষণায় মিশ্র ফলাফল পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
আবার কর্মক্ষেত্রে গাঁজার ব্যবহারের প্রভাব নিয়ে অন্য গবেষণায় দেখা গেছে, সৃজনশীল কাজের মূল্যায়নে প্রভাব ফেলার পাশাপাশি গাঁজার অন্য ধরনের ক্ষতিকর প্রভাবও থাকতে পারে। এ ধরনের নেতিবাচক প্রভাবের মধ্যে রয়েছে উৎপাদনশীলতা ও কর্মদক্ষতা কমে যাওয়া।
লেডি গাগা বলেছিলেন, তিনি গান লেখার সময় প্রচুর গাঁজা সেবন করেন। কিন্তু বাস্তবে গাঁজার ক্ষমতা অত নয় বলেই প্রাথমিক গবেষণাগুলো থেকে জানা যাচ্ছে। যদিও মানব শরীর ও মনের ওপর গাঁজার প্রভাব নিয়ে আরও অনেক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।