মো. আমির হোসেন (৫২), কাজ করতেন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকার একটি ফাস্টফুডের দোকানে। সেখানে থেকেই দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে আসছিলেন নিজের অজ্ঞান পার্টি।
অন্তত ৩০০ প্রবাসীকে লুট করেছেন তিনি। নিজের তিন সহযোগীসহ র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) কর্তৃক আটক হয়েছেন আমির।
শনিবার (১ অক্টোবর) রাতে বিমানবন্দর থানা ও কদমতলী থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করে র্যাব। এ সময় জানা যায়, গত ১৫ বছর ধরে তিনি অজ্ঞান পার্টির মাধ্যমে প্রবাসীদের মূল্যবান মালামাল হাতিয়ে নেওয়ার কাজ করছেন।
জানা গেছে, আমিরের চক্রের কর্মকাণ্ড পরিচালনা হতো বিমানবন্দর ঘিরেই। তার সদস্য টার্মিনালে ওঁৎ পেতে থাকতেন। প্রবাসীদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের টার্গেট করতেন তারা। পরে পাসপোর্ট ও লাগেজ নিয়ে বিমানবন্দরের টার্মিনাল হতে যাত্রীর ছদ্মবেশে ওই প্রবাসফেরত ব্যক্তিকে অজ্ঞান করে লুট করতেন সর্বস্ব।
অজ্ঞান পার্টির আটক অপর সদস্যরা হলেন- মো. লিটন মিয়া ওরফে মিল্টন (৪৮), আবু বক্কর সিদ্দিক ওরফে পারভেজ (৩৫) ও জাকির হোসেন (৪০)। আটকের সময় তাদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন, অজ্ঞান করার কাজে ব্যবহৃত ট্যাবলেট, যাত্রীর ছদ্মবেশ ধারণে ব্যবহৃত লাগেজ ও চোরাই স্বর্ণ জব্দ করা হয়।
র্যাব অজ্ঞান পার্টির মূলহোতা আমির হোসেনের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় ১৫টির বেশি মামলা রয়েছে। তিনি কয়েকবার কারাভোগ করে জামিনে বেরিয়ে আবারও একই অপরাধে জড়াতেন। চক্রে আরও ৬-৭ জন বিভিন্ন সময়ে যুক্ত ছিল; যার মধ্যে একাধিক সদস্য বর্তমানে কারাগারে রয়েছে।
রোববার (২ সেপ্টেম্বর) দুপুরে কারওয়ান বাজার মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, গত ২ সেপ্টেম্বর কুয়েত প্রবাসী এক ব্যক্তি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান। এ সময়ে ওঁৎ পেতে থাকা অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা তাকে টার্গেট করে। ওই ব্যক্তি ঢাকা থেকে বগুড়া যাওয়ার পথে আমিরের চক্রের সদস্যরা তাকে অজ্ঞান করে সর্বস্ব লুট করে নেয়।
এ বিষয়ে দায়েরকৃত মামলার পরিপ্রেক্ষিতে র্যাব গোয়েন্দা নজরদারী বাড়ায়। যার ধারাবাহিকতায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানের সিসিটিভি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে চারজনকে শনাক্ত করে আটক করা হয়।
গ্রেফতারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে তিনি জানান, এ চক্রের সদস্য সংখ্যা ৮ থেকে ১০ জন। তারা বিভিন্ন পেশার আড়ালে গত ১৫ বছর ধরে রাজধানীর বিমানবন্দর টার্মিনালে বিদেশ থেকে আগত ব্যক্তিদের টার্গেট করতে হাতে পাসপোর্ট ও লাগেজ নিয়ে যাত্রীর ছদ্মবেশে অপেক্ষা করতেন। চক্রটি এমন প্রবাসীদের টার্গেট করতো, যারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল; অর্থাৎ যার জন্য অপেক্ষমাণ কোনো আত্মীয় স্বজন বা গাড়ি নেই। তারা কৌশলে বিদেশ ফেরত ব্যক্তির সঙ্গে কুশল বিনিময় করে চক্রের অন্য সদস্যদের তাদের কাছের আত্মীয় হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিত। পরবর্তীতে ভুক্তভোগীর সঙ্গে একই এলাকার ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হয়ে তাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করত। তারা গাড়ি বা বাসে ভ্রমণের সময় ভুক্তভোগীকে কৌশলে চেতনানাশক ওষুধ মিশ্রিত বিস্কিট খাইয়ে দিত। তিনি অচেতন হয়ে পড়লে তার সঙ্গে থাকা সমস্ত কিছু লুট করে পরবর্তী কোনো স্থানে নেমে যেত চক্রের সদস্যরা।
সর্বশেষ যে ব্যক্তি ভুক্তভোগী হয়েছেন, যে ঘটনার বিবরণ দিয়ে র্যাবের এ কর্মকর্তা গত ২ সেপ্টেম্বর ভোরে কুয়েত প্রবাসী ভুক্তভোগী বিমানবন্দরে পৌঁছান। এরপর চক্রটির একজন সদস্য বিমানবন্দর থেকে তাকে অনুসরণ করতে থাকেন। ভুক্তভোগী উত্তরবঙ্গে যাওয়ার উদ্দেশ্যে আজিমপুর বাস স্ট্যান্ডে এসে পৌঁছান। সেখানে আগে থেকেই অবস্থান করছিলেন আমির হোসেন। ওই ব্যক্তি উত্তরবঙ্গগামী বাস কাউন্টারে টিকিট কাটতে গেলে প্রবাসী যাত্রীর ছদ্মবেশে থাকা আমির জানান, তার কাছে অতিরিক্ত টিকিট আছে।
এ সময় তারা কুশল বিনিময় করেন। পরে আমির তার কাছে থাকা একটি লাগেজ ও কিছু কুয়েতি দিনার দেখিয়ে বোঝান তিনিও প্রবাসী। ভুক্তভোগী আমিরকে বিশ্বাস করে তার কাছ থেকে টিকিট কেনেন। পরে তারা এক সঙ্গে বগুড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কিছুক্ষণ পর আমির ওই ব্যক্তিকে বিস্কিট খেতে দেন। এর কিছুক্ষণ পর ভুক্তভোগী অজ্ঞান হয়ে গেলে আমির তার সব মালামাল নিয়ে বাস থেকে নেমে যান। বাসটি নির্দিষ্ট স্টপেজে গেলে সুপারভাইজার ভুক্তভোগীকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করেন।
খন্দকার আল মঈন বলেন, আটক আসামিদের বিরুদ্ধে আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।