দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল দিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে আমদানি কমে গেছে ৮৮ হাজার ৯৩ মেট্রিক টন পণ্য। গত বছরের জুলাই ও আগষ্ট মাসে আমদানি হয়েছিল ৩ লাখ ৯৭ হাজার ৬৪২ মেট্রিক টন পণ্য, আর চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই ও আগষ্ট মাসে আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ৯ হাজার ৫৪৯ মেট্রিক টন পণ্য। এই দুই মাসে কাস্টমসের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯১০ কোটি টাকা। সেখানে আদায় হয়েছে ৭৫৭ কোটি ২১ লাখ টাকা। কাস্টমস ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলার সংকটের কারণে সরকার আমদানিতে নিরুৎসাহিত করছে। একারণে ৭৫ থেকে শতভাগ এলসির মার্জিন দিতে হচ্ছে। এতে ব্যবসায়ীরা আমদানি করতে পারছেনা। আবার বেনাপোলে নানা হয়রানির কারণে অনেক ব্যবসায়ী অন্য বন্দরে চলে যাচ্ছেন।
সম্প্রতি যশোর বিমানবন্দর থেকে ২৩ লাখ টাকাসহ বেনাপোল কাস্টমের সহকারি রাজস্ব কর্মকর্তা আটক হবার ঘটনায় তাদের ঘুষ বাণিজ্য ওপেন হয়ে যায়। বিষয়টি অনুসন্ধ্যানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন যশোর কার্যালয়। ইতিমধ্যে তারা অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি টাকার উৎস জানাতে পারেনি। যেকারণে বিষয়টি তদন্ত করে মামলার দিকে এগোচ্ছে দুদক।
বেনাপোল কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য আমদানি হয়েছিল ২১ লাখ ১৪ হাজার মেট্রিক টন। এর আগের ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি করা হয়েছিল ২৬ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন পণ্য। আমদানি কম হয়েছিল ৪ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন। এতে সরকারের রাজস্ব আয়ও কমে গেছে। গেল বছরে বেনাপোল কাস্টমস হাউজে ৫৫৮ কোটি টাকা ৮ লাখ টাকা রাজস্ব কম আদায় হয়েছে। অর্থবছরটিতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা, সেখানে আদায় করা হয়েছে ৪ হাজার ৫৯৯ কোটি ৯২ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ হাজার ২৪৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, সেখানে আদায় হয়েছিল ৪ হাজার ১৪৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা। ওই বছর ঘাটতি ছিল ২ হাজার ৯৯ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।
২০১৯-২১ অর্থবছরে পণ্য আমদানি করা হয়েছিল ২০ লাখ ৩৮ হাজার ৬৪ মেট্রিক টন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পন্য আমদানি করা হয় ২০ লাখ ১১ হাজার ৬ মেট্রিক টন পণ্য।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক নাসির উদ্দিন বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়াতে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের বেনাপোল দিয়ে বাণিজ্যে আগ্রহ বেশি। তবে বর্তমানে ডলার সংকটের কারণে সরকার এলসিতে শতভাগ মার্জিন শর্ত দিয়েছে। একারণে ব্যবসায়ীরা এলসি করতে পারছেনা। এতে জুলাই ও আগষ্ট মাসে আমদানি কমে গেছে। তবে চলতি মাসে আরও আমদানি কমবে বলে আশংকা করছি।
যশোরের আমদানিকারক এজাজ উদ্দিন টিপু বলেন, আমরা মোটরসাইকেল পার্টস ও টায়ার আমদানি করে তা সারা দেশে বিক্রি করে থাকি। আমাদের এলসি করতে এখন ৭৫ ভাগ মার্জিন দিতে হচ্ছে। অর্থ্যাৎ যে টাকার পণ্য আমদানি করতে হবে তার সমপরিমান টাকা ব্যাংকে জমা দিতে হচ্ছে। এতে নগদ টাকার সংকটে পড়ছি আমরা। পণ্য আনতে না পারার কারণে ব্যবসায়ীক ভাবে লোকসান হচ্ছে। সামনে কি পরিস্থিতি হবে কে জানে।
ইন্দো-বাংলা চেম্বার অফ কমার্স সাব কমিটির পরিচালক মতিয়ার রহমান জানান, এলসির মার্জিন বেশি হাবার কারণে আমদানি কম হয়েছে গেল জুলাই ও আগষ্ট মাসে। তবে ভারতের কালিতলায় পার্কিং সিন্ডিকেট ভেঙ্গে যাবার কারণে আবারও আমদানি বেনাপোল বন্দর দিয়ে বাড়বে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক আমদানিকারক জানান, নানা হয়রানি আর বন্দর ব্যবস্থাপনায় অনিয়মনের কারণে অনেক ব্যবসায়ী বেনাপোল ছেড়ে অন্য বন্দরে চলে গেছে। সবখাতে টাকা দিতে হয় বাধ্যতামূলক। তা না হলে বিভিন্ন অজুহাতে আমদানিকারকদের হয়রানির শিকার হতে হয়।
যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান খান জানান, সরকার এলসি করতে ৭৫ শতাংশ মার্জিন নিচ্ছে। অনেক সময় আমদানিকারকদের শতভাগ টাকা দিয়ে এলসি করতে হচ্ছে। এতে করে নগদ টাকার চরম সংকট তৈরি হয়েছে। আবার যে রেটে এলসি করতে হয়, পণ্য আসার পর কারেন্ট রেটে ডলারের পেমেন্ট করতে হয়। সব মিলিয়ে আমদানিকারকরা বেকায়দায় পড়েছে। একেতো বাণিজ্য ভালো নেই, তার উপর পণ্য আমদানি করতে না পারলে আমদানির সাথে জড়িতরা আর্থিকভাবে পঙ্গু হয়ে যাবে।
বেনাপোল কাস্টম হাউজের যুগ্ম কমিশনার মো: আব্দুল রশীদ মিয়া জানান, ডলার সংকটে বাংলাদেশ ব্যাংক এলসির মার্জিন বাড়িয়েছে। এতে করে ব্যবসায়ীরা আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন। অতি জরুরি ছাড়া পণ্য আনছে না তারা। যে কারণে গেল জুলাই ও আগষ্ট মাসে পণ্য আমদানি কমে গেছে। এখানে কোন হয়রানি হয় না বলে তিনি দাবি করেছেন।
সোনালী ব্যাংক যশোর কর্পোরেট শাখার ডিজিএম ও শাখা ইনচার্জ মো: আজিজুল ইসলাম জানান, উচ্চ মার্জিনের কারণে সব ব্যাংকে এলসি কমেছে। ব্যবসায়ীরা নগদ টাকার জোগান দিতে না পারার কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। গত জুলাই ও আগষ্ট মাসে অর্ধেকে নেমেছে এলসির হার। চলতি মাসে আরও কমবে বলে মনে হচ্ছে।