করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেই বিশ্বের বহু দেশে ছড়িয়ে পড়েছে আরেক সংক্রামক ভাইরাস মাঙ্কিপক্স। সংক্রামক এই ভাইরাস এতোদিন মানুষের দেহে শনাক্ত হলেও এবারই প্রথমবারের মতো মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হয়েছে একটি কুকুর।
মূলত সংক্রমিত ওই কুকুরটি তার মালিকের কাছ থেকে মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। বৃহস্পতিবার (১৮ আগস্ট) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানুষের বাইরে কোনো প্রাণীর মাঙ্কিপক্স ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কোনো ঘটনা এটিই প্রথম। আর তাই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেউ মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হলে পোষা প্রাণী থেকে আলাদা থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। কুকুরের মাঙ্কিপক্সে সংক্রমণের এই ঘটনা ঘটেছে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে।
অবশ্য একজন বিশেষজ্ঞ বিবিসিকে বলেছেন, মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত কোনো কুকুর অন্য কুকুর বা মানুষের মধ্যে এই রোগ ছড়াতে পারে এমন কোনো প্রমাণ এখনও নেই। যদিও অন্যান্য প্রাণীদের সংক্রামিত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে সাবধানতার প্রয়োজনীয়তার বিষয়েও সতর্ক করেছে ডব্লিউএইচও।
বিবিসি বলছে, মাঙ্কিপক্সে সংক্রমিত কারও ত্বক থেকে অন্যের ত্বকের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এই ভাইরাস। এছাড়াও এই ভাইরাসে আক্রান্ত কারও কাপড়, বিছানা বা তোয়ালে স্পর্শ করেও যে কেউ মাঙ্কিপক্সে সংক্রমিত হতে পারেন। বিশ্বজুড়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৫ হাজার মাঙ্কিপক্স রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। আক্রান্তদের বেশিরভাগই ইউরোপ এবং উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশের বাসিন্দা। এছাড়া ভাইরাসের এই প্রাদুর্ভাবের সাথে যুক্ত ১২ জন মারা গেছেন।
এর আগে সংক্রমণ বৃদ্ধির জেরে গত জুলাই মাসের শেষের দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) মাঙ্কিপক্সকে গ্লোবাল হেলথ ইমার্জেন্সি বা বিশ্ব স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা হিসাবে ঘোষণা করে। গত ২৭ জুলাই ডব্লিউএইচও’র প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রেইয়েসুস সাংবাদিকদের বলেন, মাঙ্কিপক্সের এই প্রাদুর্ভাব কমানো যায়। তবে সবচেয়ে ভাল পন্থা হল ঝুঁকির রাস্তা থেকে সরে আসা।
তিনি বলেন, এক্ষেত্রে ‘নিজের জন্য ও অপরের জন্য নিরাপত্তা রাখা ও নিজের সেক্স পার্টনারের সংখ্যা কমানো’ প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, এই বার্তা সেইসব পুরুষদের জন্য ‘যারা পুরুষসঙ্গীদের সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হন।’
ডব্লিউএইচও’র প্রধান আরও বলেন, ‘যদি আমরা (যৌনসঙ্গী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে) আর একটু সংযমী ও সচেতন হই, সেক্ষেত্রে এই রোগের ছড়িয়ে পড়া ঠেকানো সম্ভব। এই রোগ থেকে আত্মরক্ষা অনেকটাই নির্ভর করছে নিজের ওপর।’
এদিকে মানুষ থেকে কুকুরের মধ্যে মাঙ্কিপক্স সংক্রমণের প্রথম এই ঘটনাটি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ঘটেছে এবং এ বিষয়টি দ্য ল্যানসেটের একটি রিপোর্ট সামনে আসে। বিবিসি বলছে, প্যারিসের দু’জন পুরুষ একসঙ্গে একই বাড়িতে বসবাস করেন এবং তারা পুরুষদের সাথে যৌনমিলন করে মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হন।
আর নিজেরা মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হওয়ার ১২ দিন পর তাদের পোষা কুকুরের শরীরেও তারা সংক্রামক এই ভাইরাসের লক্ষণগুলো দেখতে পান। জেনেটিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ওই দুই পুরুষের মতো একই ধরনের মাঙ্গিপক্স ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে তাদের কুকুরটি। এছাড়া ওই দুই পুরুষ ঘুমানোর সময় কুকুরকে সঙ্গে নিয়েই ঘুমাতো।
এর আগে গত জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, মাঙ্কিপক্সের ৯৫ শতাংশ সংক্রমণ ছড়িয়েছে যৌন ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ নিয়ে গবেষণাটি প্রকাশিত হয়। মাঙ্কিপক্স নিয়ে বিশ্বে এটিই এখন পর্যন্ত হওয়া সবচেয়ে বড় গবেষণা।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, সামগ্রিকভাবে মাঙ্কিপক্সে সংক্রমিত ৯৮ শতাংশই সমকামী বা উভকামী পুরুষ। আক্রান্তদের ৪১ শতাংশের এইচআইভি ছিল এবং গড় বয়স ৩৮ বছর। মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত এসব মানুষের আগের তিন মাসে তাদের যৌন সঙ্গীর গড় সংখ্যা ছিল পাঁচ জন।
এছাড়া ভাইরাসে সংক্রমিতদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হওয়ার আগের মাসের মধ্যে সেক্স পার্টি বা সানাসের মতো সেক্স-অন-সাইট ভেন্যুতে গিয়েছিলেন বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, মাঙ্কিপক্স ভাইরাসজনিত অসুখ। স্মলপক্স ভাইরাস শ্রেণির একটি ভাইরাস এ রোগের জন্য দায়ী। ভাইরাসটির দু’টি রূপান্তরিত ধরন রয়েছে— মধ্য আফ্রিকান ও পশ্চিম আফ্রিকান।
মাঙ্কিপক্সের লক্ষণগুলো সাধারণত জ্বর, মাথাব্যথা, পেশিতে ব্যথা, পিঠে ব্যথা, ঠান্ডা লাগা এবং ক্লান্তি থেকে শুরু হয়। এই রোগে আক্রান্ত হলে সাধারণত দুই থেকে চার সপ্তাহ স্থায়ী হয় এবং সংক্রমণের পাঁচ থেকে ২১ দিনের মধ্যে যেকোনো জায়গায় উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
একবার মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হয়ে জ্বর হলে, প্রথমে বসন্ত (পক্স) রোগের মতোই একটি-দু’টি করে গুটি দেখা যায় শরীরে। এক থেকে তিন দিন পর তা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো মুখ থেকে শুরু হয়ে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে।