অনুপ্রবেশকারীরা সত্যিকারের আওয়ামী পরিবারের লোকদের 'কোনঠাসা' করে রেখেছে বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। তিনি বলেন, "এই অবস্থা চলতে দেওয়া যাবে না।"
রবিবার দুপুরে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মিলনায়তনে আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ উপ-কমিটির আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন।
লিটন বলেন, "আমার সামনে যারা আছেন তরুণ প্রজন্ম, অনেক কাজ সামনে। পনের বছর সরকার একটানা ক্ষমতায়, দলের মধ্যে অনুপ্রবেশ ঘটেছে। আমার আগেও আমাদের প্রয়াত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আমার শ্রদ্ধাভাজন বড় ভাই তিনি তখনই বলেছেন দলে অনুপ্রবেশকারী ঢুকেছে। সত্যই অনেক জায়গায় ঢুকেছে। তাদেরকে আমরাই ঢুকিয়েছি, পদ-পদবি দিয়েছি, আসন দিয়েছি।
"তারা আজকে ঐখানে যারা অরিজিনাল আওয়ামী লীগার, বংশগতভাবে আওয়ামী লীগ করে তাদেরকে একদম গোল করে ঘিরে রেখেছে। তাদের আলাদা করে রেখেছে, যে তারা আওয়ামী লীগ নয়। যারা অনুপ্রবেশ করেছে তারাই বলছে আমরা আওয়ামী লীগার, আর যারা আসল আওয়ামী লীগের তাদের বাইরে রেখেছে। এই অবস্থা চলতে দেওয়া যাবে না। আমি জানি, আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা সমস্ত খবর রাখেন। তিনিও এবার এই সমস্ত বিষয়ে অনেক বেশি নজরদারি করছেন এবং করবেন।"
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিই লড়াই সংগ্রামে আগে আসে জানিয়ে লিটন বলেন, "সামনের লড়াইয়ে লড়তে হলে আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এবং সন্তান আমরাই রাজপথে লাঠি নিয়ে যাবো। ঐ হাইব্রিডরা যাবে না। আমাদেরকেই যেতে হবে। এই দেশের স্বাধীনতা আমাদের বাবার, আমাদের জাতির পিতা, আমাদের প্রত্যেকের বাবা-চাচা, তারা নিয়ে এসেছেন।
"আমাদের দরদ বেশি, আমরা এই বাংলাদেশকে ওউন করি। এই বাংলাদেশে উন্নয়ন হচ্ছে এতে আমরা খুশি হচ্ছি। আমরা দেখতে চাই বাংলাদেশ আরও উন্নত হবে। কোনো চোরার দলকে ক্ষমতায় গিয়ে বোমাবাজি আতঙ্ক লুটপাট, হাওয়া ভবন বানানো; এটা করতে দিতে চাই না। আপনারা তরুণ প্রজন্ম সেই ভাবে প্রস্তুতি রাখবেন।"
এ সময় বিএনপি মহাসচিবের সমালোচনা করে আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, "বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল বলছে, সুনামিতে আওয়ামী লীগ পালিয়ে যাবে। কে পালায় সেটা দেখা যাবে।
"তবে আপনাদের নেত্রী আজ থেকে ছয়-সাত বছর আগে, ঐ যে আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়েছিলেন, সেই আন্দোলন কিন্তু বাতিল করেননি বা স্থগিত করেননি। সেই কর্মসূচি চলছে, এর মধ্যদিয়ে সরকার গঠন হলো, নির্বাচন হলো, উন্নয়ন হচ্ছে, পদ্মা সেতু হলো, কর্ণফুলী টানেল হচ্ছে, সেই রকম আন্দোলন যদি করেন, করতে পারেন। কোনো সমস্যা নেই। আমরা এটা মোকাবেলার জন্য তৈরি আছি।"
এ সময় দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিসহ নানা কৌশলের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ক্ষেত্র কারা তৈরি করেছিল তা সামনে নিয়ে এসেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি মন্ডরীর সদস্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার ক্ষেত্র তৈরিতে তৎকালিন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র যারা গঠন করেছিল তাদের দায়ী করে লিটন বলেন, "যে মানুষটি সারা জীবনের সুখ- স্বাচ্ছন্দ ভুলে গিয়ে হাজার বছরের স্বপ্ন, যে আমাদের একটা স্বাধীন ভুখন্ড থাকবে, পরাশক্তি আমাদের শাসন শোষণ করবে না। সেই বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন। সেই মানুষটি দেশ স্বাধীন করার মাত্র এক বছরের মাথায় বাংলাদেশে যেটা ঘটলো।
"এটা্ ইতিহাসের অংশ, এখন শুনতে খারাপ লাগলেও মনে রাখতে হবে। মাত্র এক বছরের মাথায় এর আগে কিন্তু ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য ইন্ধিরা গান্ধিকে অনুরোধ করেছেন বঙ্গবন্ধু এবং ভারতীয় সৈন্য রেকর্ড টাইমে, অত্যান্ত দ্রুততম সময়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে গেলো।"
জাতীয় চার নেতার একজন কামরুজ্জামানের ছেলে লিটন বলেন, "বঙ্গবন্ধুর ক্ষমতায় আসার এক বছরের মধ্যে কি এমন ঘটলো? যে বাংলাদেশে একটি দল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান দিয়ে গঠন করা প্রয়োজন হলো? কারা ছিলেন পেছনে? কারা নেপথ্যে ছিলেন। সমাজতন্ত্রকে যদি আমরা মনে করি একটা বৈজ্ঞানিক বিষয় তাহলে তার আগে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র হাজির করেছিল কারা? আমরা জানি।
"বেঁচে আছেন সিরাজুল আলম খান তাত্ত্বিক নেতা, আরও যারা ছিলেন, তাদের নাম আমি বলছি না। নাম আপনারা সবাই জানেন। তারা মিলে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র করলেন। পরাশক্তির ইন্ধন ছিল নিশ্চয়ই, তা না হলে তৎকালিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনছুর আলীর বাড়ির সামনে জাসদের মিছিল থেকে গুলিবর্ষণ হয় কোন সাহসে। ঈদের জামাতে সংসদ সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয় কোন সাহসে। ব্যাংক ডাকাতি করে জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে আওয়ামী লীগকে দায়ী করা হয়, কারা করে? বঙ্গবন্ধুর সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামালকে কারা বদনাম করে। কারা ঐ কুড়িগ্রামের পাগল বাসন্তী, তার গায়ে মাছ ধরার জাকি জাল, যে জালের দাম তখনকার সময়ে একটি শাড়ির চেয়ে তিনগুন, সেই জাল তার গায়ে পরিয়ে দিয়ে পত্রিকায় ছাপিয়ে বলে, এই হলো শেখ মুজিবের বাংলাদেশ যেখানে মায়েরা লজ্জা নিবারণের শাড়িও কিনতে পারে না। কারা ওরা? যারা ঢাকার সলিমুল্লাহ মিডফোর্ট হাসপাতালে মরা মানুষের কলিজা খাচ্ছে, সে পাগল, বদ্ধ পাগল। ইত্তেফাকে ছবি ছাপিয়ে বলা হচ্ছে শেখ মুজিবের আমলে মানুষ খেতেও পারছে না।
"কারা, কারা ওরা? যাদের পরামর্শে দেশে অনাবৃষ্টি ও অতি বৃষ্টিতে ফসল কম হওয়ায় একটু খাদ্যাভাব হতে পারে দুর্ভিক্ষ হতে পারে সেই আশঙ্কায় বঙ্গবন্ধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গম চাইলেন 'পিএল ৪৮০'। তখনকার একটা পলিসি ছিল, সেই পলিসির অধীনে জাহাজ কাছাকাছি এসেও চলে গেলে, ফিরে গেলো। কারা ফেরত পাঠালেন? কারা ক্ষেত্র তৈরি করলেন দুর্ভিক্ষের? কিছু মানুষ তো মারা গেলই। কারা এটা করলেন। তারাই তো এই চক্র, চক্রান্ত করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার ক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন।"
পরাশক্তির অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে ভয় করতেন জানিয়ে আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, "তাদের ভাষায় শেখ মুজিবকে হত্যা করা হবে, কারণ শেখ মুজিবকে তারা ভয় পেতেন। বঙ্গবন্ধুকে তারা ভয় পেতো, কারণ বঙ্গবন্ধু ছিলেন হিমালয়ের মতো। বঙ্গবন্ধু তৃতীয় বিশ্বের তৎকালীন বড় বড় নেতাদের সঙ্গে চলতেন। তাকে ভয় করতো একাত্তরে পরাজিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তারা এখন আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র হয়তোবা হয়েছে, রাজনীতিতে স্থায়ী কোনো শত্র-মিত্র নেই আমরা জানি।
"ইতিহাসটা আমাদের তরুণ প্রজন্মের মনে রাখতে হবে। কারা মহান মুক্তি সংগ্রামে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল পাকিস্তানকে বাঁচানোর জন্য, কারাই বা আরেকটি বহর পাঠিয়েছিল আমাদেরকে রক্ষা করতে। সেটা জানেন, একটা আমেরিকা আরেকটা রাশিয়া।"
লিটন বলেন, "বঙ্গবন্ধু যখন দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, মাত্র তিন সাড়ে তিন বছরে, তিনি তো কম দেননি। তিনি সেই নেতা যিনি স্বাধীনতার পর ফিরে যাচ্ছে ব্রিটিশ শেল কোম্পানি। যারা ফিরে যাচ্ছে তেল এবং গ্যাস ক্ষেত্র রাখবে না। ফিরে যাচ্ছে তখন বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর মাত্র ছয় দিন আগে ৯ আগস্ট তিনি মাত্র ৪.৫ মিলিয়ন পাউন্ড, তখন পাউন্ড ছিল বার টাকা করে।
"গত দুই দিন আগ পর্যন্ত আমরা পেয়েছি ১ লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকার গ্যাস। আমরা ওখান থেকে ব্যবহার করেছি, বঙ্গবন্ধু কত দূরদর্শী দেখেন, চক্রান্ত হচ্ছে জানতেন তারপরেও তিনি গ্যাস ক্ষেত্র কিনে নিলেন। যে এটা আমার বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা দেবে। আরও অন্তত পাঁচ বছর আমরা এখান থেকে গ্যাস পাব। এইরকম একজন মানুষ বাঁচিয়ে রাখলে এই অঞ্চলের যেখান থেকে ভারত কাছে, চায়না কাছে আমাদের বঙ্গোপসাগর দিয়ে সারা পৃথিবীতে যাতায়াতের অবাধ সুযোগ আছে। অতএব এখানে একটা নতজানু সরকার দরকার যাকে বলে দুর্বল অপদার্থ, অতটা দেশ প্রেমিক নয় তাকে বসাবে।এই কারণে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র হলো।"
খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, "বঙ্গবন্ধুর খুনিরা ভাড়াটিয়া, রশিদ হুদা, তারা হচ্ছেন স্রেফ ভাড়াটিয়া খুনি। মুল মাস্টার মাইন্ড পরাশক্তি, বিদেশি শক্তি বাদ দিলে জিয়াউর রহমান এক নম্বর। তার উচ্চাভিলাশ, প্রমানিত হয়েছিল যখন কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে নিজের নাম দিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়া শুরু করেছিল। পরে যখন বলা হলো, আপনাকে কে চিনে আপনি ঘোষণা দেওয়ার কে? তখন বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে ঘোষণা দিলো।
"এই যে উচ্চাভিলাশ তখন থেকেই খন্দকার মোস্তাক, বদরুল হুদা, রশিদ, ফারুক, ডালিম তাদের মধ্যে একটা যোগসূত্র হলো। তারই প্রমাণ হলো ১৯৭৫ সালে, বঙ্গবন্ধু খুন হয়ে সিঁড়িতে পড়ে আছেন, তখন জিয়াউর রহমান সাড়ে চারটার দিকে লাইট জ্বালিয়ে শেভ করছেন, তৈরি হবেন, কারণ তার কাজ, মিশন কমপ্লিট হয়েছে। এখন তাকে যেতে হবে। পরবর্তী কার্যক্রম হাতে নেওয়ার জন্য। বঙ্গবন্ধুর লাশ সিঁড়িতে পড়ে আছে, জিয়াউর রহমান কিছু দিনের জন্য মোস্কতাককে ক্ষমতায় দিলো, খুনির দায় মুক্তিতে জিয়ার নির্দেশে পার্লামেন্টে পাঠালো। পরে জিয়াউর রহমান সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনিতে অন্তর্ভুক্ত করলো।"
এ সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে সপরিবারে হত্যার নেপথ্যে ষড়যন্ত্র ও সহায়তাকারীদের খুঁজতে তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানান আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ সম্পাদক এবং বন ও পরিবেশ উপ-কমিটির সদস্য সচিব দেলোয়ার হোসেন।
তিনি বলেন, "বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্য নায়কদের খুঁজে বের করতে তদন্ত কমিশন গঠন এখন সময়ের দাবি। কমিশন গঠন করে নেপথ্যের ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে জানাতে হবে, আমাদের জানতে হবে বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যে কি হয়েছিল, কারা পর্দার আড়ালে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল। সেই রাতের নির্মম হত্যা কান্ডের কাহিনি আমাদের জানতে হবে।"
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য বন ও পরিবেশ উপ-কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দকার বজলুল হকের সভাপতিত্বে আরও উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য সৈয়দ আবদুল আওয়াল শামীম, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্বদ্যিালয়ের সাবেক উপাচার্য শ্রী পবিত্র সরকার, ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য নাসরীন আহমাদ, কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, সাংবাদিক আবেদ খান।
আলোচনা সভার সঞ্চালনা করেন আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ সম্পাদক এবং বন ও পরিবেশ উপ-কমিটির সদস্য সচিব দেলোয়ার হোসেন।