অমলিন ঐতিহ্য ও অপরূপ সৌন্দর্যের আঁধার রায়পুরের ডাকাতিয়া নদী। ঋতু পরিবর্তন হতেই নীল আকাশের নিচে অপরূপ সৌন্দর্য ধারণ করেছে এই ডাকাতিয়া নদী। বলা যায় বর্ষার পানি আসায় যেন, হারানো যৌবন ফিরে পেয়েছে নদীটি। গ্রামীণ জনপদে প্রকৃতি যেন বিলিয়ে দিয়েছে এক অফুরন্ত সম্ভাবনা এবং মনভোলানো অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্য। সৌন্দর্যের ষোলোকলায় পরিপূর্ণ এই নদীটি ভ্রমণ পিপাসুদের মনে জোগায় আনন্দের খোরাক। আজ আপনাদের শোনাব ঠিক তেমনি একটি নৌ-ভ্রমণগল্প। সকাল আটটা ৫ মিনিট, রায়পুর উপজেলা শহরের শহিদ মিনার এলাকা থেকে সিএনজি যোগে রওনা হলাম আমি ও সফরসঙ্গী কামরুল সোহান। কয়েক কিলোমিটার পথ সিএনজি যোগে পাড়ি দিয়ে পৌঁছে গেলাম রায়পুরের সীমান্তবর্তী দেবীপুর গ্রামে। সেখানে পৌঁছে স্থানীয় দুই পরিচিত সঙ্গী ও হালকা নাস্তা সঙ্গে নিয়ে রওনা হলাম নৌকা যোগাড় করতে । অবশ্য স্বল্প প্রচেষ্টায় পেয়ে গেলাম একটি ডিঙি নৌকা। নৌকার মালিকের সাথে টাকা-কড়ির বিষয়াদি সেরে ঠিক বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ শুরু হলো আমাদের নৌকার যাত্রা। নৌকা বাইতে পারদর্শী হওয়ায় চারজন মিলে ডাকাতিয়ার বুক চিরে পাড়ি দিলাম চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জের শেষ সীমানা পর্যন্ত।
ডাকাতিয়ার পাড় ঘেঁষে বিস্তীর্ণ জনপদ, মাঠ ভরা ফসল, আর নদী তীরের কোনো এক উন্নত জাতের শোভাবর্ধক ঘাঁষ ছিলো আমাদের মূল আকর্ষণ। এতক্ষন তো বললাম ভ্রমণের কথা, এবার একটু থেমে ডাকাতিয়ার অতীত তুলে ধরা যাক, ডাকাতিয়া মূলত বাংলাদেশ-ভারতের আন্তঃসীমান্তের একটি নদী। এটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২০৭ কিলোমিটার এবং প্রস্থ প্রায় ৬৭ মিটার (২২০ ফুট)। এটি আসলে মেঘনার একটি উপনদী। ভারতের ত্রিপুরার পাহাড় হতে উৎপন্ন হয়ে কুমিল্লার বাগসারা হয়ে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে এবং পরবর্তীতে প্রবাহিত হয়েছে লক্ষ্মীপুর,চাঁদপুর জেলার ওপর দিয়ে। নদীটি মূলত কুমিল্লার লাকসাম, নাঙ্গলকোট ও মনোহরগঞ্জ, চাঁদপুরের শাহরাস্তি ও হাজীগঞ্জ উপজেলা অতিক্রম করে চাঁদপুরের মেঘনা নদীতে সঙ্গম ঘটিয়েছে। ডাকাতিয়ার ধরণ প্রকৃতি সর্পিলাকার। একসময় এ নদী দিয়ে মগ-ফিরিঙ্গি জলদস্যুরা নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলায় প্রবেশ করতো এবং নদীতে করতো ডাকাতি। ফলস্বরূপ ডাকাতের উৎপাতের কারণে নদীটির নাম ডাকাতিয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। আবার কারো কারো মতে, ডাকাতিয়া নদীর করাল গ্রাসের কারণে এর দুই পাড়ের মানুষ সর্বস্ব হারাত। জীবন বাঁচাতে ডাকাতিয়া পাড়ি দিতে গিয়ে অসংখ্য মানুষের সলিলসমাধি রচিত হয়েছে। ডাকাতের মতো সর্বগ্রাসী হওয়ায় এর নামকরণ করা হয়েছে ডাকাতিয়া নদী।
ডাকাতিয়া খনন না হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে নদীটি যৌবন হারালেও বর্ষা মৌসুমে নদীটির সৌন্দর্য ফিরে এসেছে। ডাকাতিয়ার লাকসাম, মনোহরগঞ্জ ও নাঙ্গলকোট, চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ অংশের বেশিরভাগ স্থান এখন ভ্রমণ পিপাসুদের আনন্দ দেয়। নীল আকাশের নিচে নদীটি সেজেছে বর্ণিল সাজে। ডাকাতিয়া এখন পানিতে টুইটুম্বর। দেখলে যেন চোখ জুড়িয়ে যায়। আবার দখল-দূষণে নাব্যতা হারিয়েছে ডাকাতিয়ার রায়পুরের একটি অংশ। তবে ডাকাতিয়ার অন্য অংশগুলো বর্ষাকালে সৌন্দর্যের লীলাভূমি হয়ে ওঠায় এ সময়ে নদীর সৌন্দর্য দেখতে গ্রামে ছুটে আসেন যান্ত্রিক শহরে থাকা মানুষগুলো। মনের আনন্দে তারা ছুটে যান ডাকাতিয়ার পানে। অনেকে দলবেঁধে নৌকাযোগে ছুটে যান দূর-দূরান্তে । নদীর বুকে অনেকে আয়োজন করেন বনভোজনের। রাতের বেলায় শীতল বাতাস ডাকাতিয়ার গর্জন পথচারীদের উদ্বেলিত করে।
সম্পদ, সম্ভাবনা আর অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্যের হাতছানি ডাকাতিয়া বর্ষা মৌসুমে রূপ ছড়িয়ে দিলেও পানি কমার সাথে সাথে ডাকাতিয়া সৌন্দর্য হারাতে থাকে। দখলদাররা ডাকাতিয়ার পাড় দখল ও মাটি কেটে নেয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। যান্ত্রিক এ সমাজে মানুষের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ ও আনন্দ উদযাপনের জন্য ডাকাতিয়ার সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরী।
নৌকা ভ্রমণে প্রায় ঘন্টা চারেকের আনন্দ উপভোগ ও ডাকাতিয়ার নৈসর্গিক দৃশ্য অবলোকন করে ক্লান্ত শরীর-শান্ত মন নিয়ে আমরা ফিরে আসি আপন আপন ঠিকানায়।