করোনা মহামারী বিশ্বব্যাপী খাদ্য ব্যবস্থায় একটা বড় প্রভাব ফেলেছিল। তার পরই ইউক্রেনে আগ্রাসন চালায় রাশিয়া। তাতেও বিঘ্ন তৈরি হলো খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায়। বর্তমানে এমন পরিস্থিতিকে আরও তীব্র করে তুলেছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বজুড়েই তাপমাত্রা বাড়ছে। কোথাও কোথাও দেখা যাচ্ছে তীব্র দাপদাহ, কমেছে বৃষ্টিপাত। ফলে কমছে সুপেয় পানির সংস্থান। এমন অবস্থায় ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে সারা বিশ্বের ফসল উৎপাদন। আর তাতে করে সংকট তৈরি হয়েছে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়েও।
তাপের তীব্রতার ফলে এমন একটি শৃঙ্খল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যেটা বিশ্বব্যাপী খাদ্যনিরাপত্তাকে প্রভাবিত করছে। গবেষকরা বলছেন, সেই ক্ষতির আশঙ্কা বেড়ে গেছে ৩০ শতাংশ।
এক ভয়াবহ তাপপ্রবাহের মুখোমুখি হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া। বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে ভারত ও পাকিস্তান ৫১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ভুগছে। তীব্র তাপের বেশকিছু প্রভাব দেখা যাচ্ছে দুটি দেশে। তার মধ্যে তীব্র লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা, ঠাণ্ডা আবহাওয়া তৈরির চেষ্টার জন্য কয়লার চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া, দ্রুত হিমবাহ গলে যাওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন হ্রদের পাড়গুলো ফেটে যাওয়া এবং এর পাশাপাশি গমের ফলন হ্রাস পেতেও দেখা যাচ্ছে।
ইউরোপজুড়েও দেখা যাচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এবার স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি গরম পড়েছে। প্রচণ্ড গরমে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। দাবদাহের কারণে প্রথমবারের মতো রেড অ্যালার্ট জারি করেছে যুক্তরাজ্য। চলতি সপ্তাহে তাপমাত্রা রেকর্ড ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। অন্যদিকে ফ্রান্স, পর্তুগাল ও স্পেনের বিভিন্ন স্থানে দাবানলে পুড়ছে বন। আগুনের হাত থেকে বাঁচাতে শতাধিক মানুষকে এসব বনের আশপাশের স্থান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। খালি করা হয়েছে ঘরবাড়ি। এ অবস্থায় ইউরোপজুড়ে তাপপ্রবাহের নতুন সতর্কবার্তা জারি করা হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও আবহাওয়ার তীব্রতার মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে কর্মরত ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশনের গবেষকরা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মার্চ-এপ্রিলে তাপপ্রবাহের সম্ভাবনা বেড়ে যায় ৩০ শতাংশ। যেহেতু বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে, তাই ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতি আরো বেশি ঘন ঘন হবে। তীব্র তাপে অনেকের মৃত্যুর খবরও পাওয়া যাচ্ছে।
তাপমাত্রার এমন পরিবর্তনে প্রভাবিত হচ্ছে খাদ্যের উৎপাদন। শস্য উৎপাদন কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় মে মাসের মাঝামাঝিতে সব ধরনের গম রফতানি নিষিদ্ধ করে ভারত। আর তার ফলে কভিড-১৯ পরিস্থিতি থেকে পুনরুদ্ধার ও রাশিয়ায় ইউক্রেনের আগ্রাসনের পর বিশ্বব্যাপী খাদ্যের সহজলভ্যতা একেবারে হুমকিতে পড়ে যায়।
ভারতের প্রত্যাশা ছিল এ বছর তাদের রেকর্ড পরিমাণ গম উৎপাদন হবে। কিন্তু তাপপ্রবাহের কারণে হয়তো ফলন প্রত্যাশা সংশোধন করতে হবে। ইউক্রেনে রাশিয়া আগ্রাসন চালানোর পর এমনিতেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় সারা বিশ্বের গম রফতানি। ইউক্রেন ও রাশিয়া একত্রে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ গম রফতানি করে। সঙ্গে ব্যাহত হয় সার রফতানিও। সেই পরিস্থিতিকে আরো তীব্রতর করে গম রফতানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা।
যদিও নয়াদিল্লির দাবি এ প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপের মাধ্যমে গম রফতানি সীমিত করার কারণ শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করাই নয়, বরং পার্শ্ববর্তী ও অন্যান্য ঝুঁকিতে থাকা দেশের কথা ভেবেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
জাতিসংঘের শীর্ষ অর্থনীতিবিদ ম্যাক্সিমো টোরেরো সতর্কবার্তা জানিয়ে বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বের খাদ্য ব্যবস্থাকে জলবায়ুর অভিঘাতের সামনে আরো বেশি উন্মুক্ত করে দিয়েছে। আর সেটার ফল আমরা চলতি বছর দেখেছি আরেকটি বড় খাদ্য রফতানিকারক দেশের ক্ষেত্রে।
জলবায়ু পরিবর্তন অনেক ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক ফলাফলের সঙ্গে আমাদের বাস্তবায়িত করে ফেলেছে। ২০২২ সাল শুধু যে সবচেয়ে গরম বছর ছিল তা-ই নয়, বরং এ বছর কার্যকরভাবে বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তাকেও ঝুঁকিতে ফেলেছে। শুধু এ বছরেই খরা ও তাপপ্রবাহের কারণে দক্ষিণ এশিয়া থেকে শুরু করে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা পর্যন্ত অনেক ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক জায়গায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেছে। ফলস্বরূপ শস্য উৎপাদন কমে গেছে ৩০ শতাংশ। পাঞ্জাব ও ভারতে গমের ফলন কমে গেছে ২০ শতাংশ, যেটা বিগত কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পতন। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি বছর পাকিস্তানের আম উৎপাদন কমে যেতে পারে ৫০ শতাংশ। এ তাপপ্রবাহ ও দাবানলের কারণে উত্তর আমেরিকায়ও প্রবল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শস্য উৎপাদন।
একই ধরনের পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে অন্যান্য অনেক দেশে। ইতালিতে তাপপ্রবাহের কারণে শুকিয়ে যাচ্ছে নদী, ফলে ব্যাহত হচ্ছে চাষাবাদ। তিউনিসিয়ায়ও এবার খাদ্য উৎপাদন কৃষকের ধারণার তুলনায় কম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে তীব্র খরার কারণে অনেক মাঠ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খরার কারণে ঝুঁকিতে পড়েছে সেখানকার এক-তৃতীয়াংশ শস্য উৎপাদন।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শুধু তীব্র খরা নয়, আকস্মিক বন্যায়ও ভুগতে হচ্ছে অনেক দেশকে। যেমন কিছুদিন আগে বন্যায় বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ শস্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চীনের একদিকে তীব্র বৃষ্টি আর অন্যদিকে অনেক বেশি তাপমাত্রা। এর ফলে সেখানেও বিভিন্ন শস্য ও সয়াবিন উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যাপক হারে।
বিশ্বের খাদ্য উৎপাদক হিসেবে সুপরিচিত বড় দেশগুলো যখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই ঝুঁকিতে পড়ে যাচ্ছে বিশ্বের খাদ্যনিরাপত্তা।