রাজধানী ফুটপাতগুলো এখনও পুরোদস্তুর মোটরসাইকেল চলাচলের জন্য ব্যবহার হয়। অথচ পথচারীদের চলাচলের একমাত্র অবলম্বন রাজধানীর ফুটপাতে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধের জন্য ২০১১ সালে উচ্চ আদালতে একটি আবেদন করেছিলেন আইনজীবী আইনুন নাহার সিদ্দিকা। তার আবেদনে সাড়া দিয়ে উচ্চ আদালত ২০১২ সালে একটি আদেশ দেন। ওই আদেশে ফুটপাতে মোটরসাইকেল যেন উঠতে না পারে তা নিশ্চিত করতে নির্দেশনা দিয়েছিলেন আদালত। কিন্তু দশ বছর আগে উচ্চ আদলতের দেওয়া ওই আদেশের বিন্দুমাত্রও কার্যকারিতা নেই কোথাও। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে ঠেকেছে যে, ওই আদেশের কথা কেউ জানেনও না।
যার ফলে যানজটে আটকে পড়া রাজধানীর ফুটপাত পুরোটাই মোটরসাইকেল আরোহীদের দখলে চলে গেছে। যানজট এড়াতে রাস্তা ছেড়ে মোটরসাইকেলগুলো প্রতিনিয়ত ফুটপাত ব্যবহার করছে। শুধু তাই নয়, মাঝে মধ্যেই পথচারীদের গায়ের উপর উঠে যাচ্ছে মোটরসাইকেল। এ নিয়ে পথচারী ও মোটরসাইকেল আরোহীদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতেও দেখা যায়।
মোটরসাইকেলের কারণে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন ফুটপাত ব্যবহারকারী সাধারণ মানুষ। যারা যানজট এড়িয়ে সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছাতে বা স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণে ফুটপাত ধরে চলাচল করেন তাদের প্রতিনিয়ত মোটরসাইকেলের সঙ্গে যুদ্ধ করে ফুটপাত ব্যবহার করতে হচ্ছে।
গত কয়েক বছরে রাজধানীর ফুটপাতগুলো অনেকটা পথচারী বান্ধব করা হয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় ফুটপাতের প্রশস্ততাও বেশ চওড়া। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে রাজধানীর এসব ফুটপাত পথচারী বান্ধব করা হলেও নগরীর ফুটপাতের বেশির ভাগই ভাসমান দোকান, হকার এবং বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালামাল রাখার কাজে ব্যবহার হচ্ছে। আর যেটুকু অব্যবহৃত থাকছে সেই অংশ যাচ্ছে মোটরসাইকেলওয়ালাদের দখলে।
বিশেষ করে রাজধানীর ফার্মগেট থেকে কারওয়ান বাজার হয়ে বাংলামোটর, শাহবাগ, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে পল্টন হয়ে দৈনিক বাংলা, মতিঝিল, কাকরাইল এলাকা, মিরপুর সড়ক, কাকরাইল মোড় থেকে মগবাজার, মগবাজার থেকে মৌচাক হয়ে শান্তিনগর, বেইলী রোড, বনানী চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে বনানী ক্রসিং পর্যন্ত সড়কগুলোর দুই পাশের ফুটপাত দিনের বেশির ভাগ সময় বিশেষ করে যানজটের সময়ে রীতিমতো মোটরসাইকেলের দখলে চলে যায়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উবার, পাঠাও- এর মতো অ্যাপসের কারণে রাজধানীতে মোটরসাইকেলের দৌরাত্ম্য বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। এসব মোটরসাইকেল চালকদের বেশির ভাগই আনাড়ি। তারা যেমন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে তেমনি ফুটপাত দখল করে মোটরসাইকেল চালাতে তারা সমান পারদর্শী।
এ কারণে যানজট এড়াতে যানবাহন থেকে নেমে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছানোর সুযোগও পথচারীদের নেই বললেই চলে। কারণ মূল সড়কের যানজটে থাকা মোটরসাইকেলগুলো যেন উপচে পড়ছে ফুটপাতে। বিভিন্ন স্থানে ফুটপাতে মোটরসাইকেল ওঠা বন্ধ করতে লোহার খুঁটি পুঁতে রাখলেও কোথাও সেগুলো ভেঙে আছে বা মোটরসাইকেলের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে ফাঁকা করে দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে সড়কে যানজট যত বাড়ছে ফুটপাতে মোটরসাইকেলের তাণ্ডবও তত বাড়ছে।
১০ বছর আগে ফুটপাত মোটরসাইকেলমুক্ত করতে আদালতের শরণাপন্ন হওয়া সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আইনুন নাহার সিদ্দিকা জানান, সংশ্লিষ্ট আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে রুল দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। তারপর ফুটপাতে মোটরসাইকেল চলতে পারবে না বলে আদেশ দিয়েছিলেন আদালত।
এই আদেশ পালন করতে ট্রাফিক পুলিশকে নির্দেশও দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। অথচ উচ্চ আদালতের দেওয়া ওই আদেশের পর ১০ বছর অতিক্রম হয়ে গেলেও তা কার্যকর করেনি ট্রাফিক বিভাগ।
তিনি বলেন, ট্রাফিক পুলিশ আদালতের আদেশ অনুসারে দায়িত্ব পালন করছে না। এই আইনজীবী একটি উদাহরণ দিয়ে বলেন, মালিবাগে সিআইডি এবং মিন্টো রোডে ডিবি অফিসের সামনে ফুটপাত ও মূল সড়ক দখল করে পুলিশই মোটর সাইকেল এমনকি নিজেদের বাস পার্কিং করছে। এসব নিয়ে কথা বললে পুলিশ মারমুখী আচরণ করে।
আইনুন নাহার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, এ নিয়ে কথা বলায় মালিবাগে একদিন এক পুলিশ সদস্য আমাকে বলেছে, 'এভাবে রাখাই ঠিক আছে। ভালো লাগলে থাকেন। আর ভালো না লাগলে দেশ ছেড়ে চলে যান'। তিনি বলেন, আইন হচ্ছে ফুটপাত পথচারীর চলাচলের জন্য ফ্রি রাখতে হবে। তাছাড়া এ নিয়ে হাইকোর্টেরও সুনির্দিষ্ট আদেশ আছে। কিন্তু হাইকোর্টের আদেশ কার্যকর হচ্ছে না। হাইকোর্টের ওই আদেশটি একটি চলমান আদেশ। আদালতের আদেশ কার্যকর না হওয়ার বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে দিয়ে আমি আদালত অবমাননার অভিযোগ এনে ঈদুল আযহার পর আদালতে আবেদন করব।
হাইকোর্টের আদেশ কার্যকর না হওয়ার বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের মতিঝিল জোনের ডিসি মো. মইনুল আহসান জানান, 'এ জন্য মানুষের অসচেতনতাই দায়ী। আমরা ফুটপাতে মোটরসাইকেল উঠতে দেখলেই তাদের সড়ক দিয়ে চলতে বাধ্য করি। ফুটপাতে মোটরসাইকেল উঠলে তাকে আইনের আওতায় আনি। কিন্তু মানুষ সচেতন না হলে শুধু ট্রাফিক পুলিশের ব্যবস্থা নিলে এটি বন্ধ করা মুশকিল'।