সরকারি ভাবে নূপুরের মন্তব্যের নিন্দা করে বিবৃতি না দেওয়া হলেও আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক উপকমিটি কিছু দিন পর একটি বিবৃতি দিতে পারে।
বিজেপি মুখপাত্রদের পয়গম্বর সংক্রান্ত নিন্দনীয় মন্তব্যের জেরে পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান-সহ পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশ এবং ইসলামি সংগঠনের তীব্র রোষের মুখে মোদী সরকার। কিন্ত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলির এই রোষানলের তালিকায় এখনও পর্যন্ত ব্যতিক্রম প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
এখনও পর্যন্ত কোনও সরকারি বিবৃতি নেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয় থেকে। তবে ভারতের এই ঘটনাকে সামনে নিয়ে এসে বাংলাদেশের মুসলিম সমাজ এমনকি, সংখ্যালঘুরাও দাবি করছেন, ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রশ্নে পশ্চিমি দুনিয়া তাদের যতই সমালোচনা করুক না কেন, হাসিনা সরকারের জমানায় পরিস্থিতি তুলনামূলক ভাবে ভারতের চেয়ে অনেকটাই ভাল।
আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন-এর গভর্নর খন্দকার গোলাম মওলা নকশেবন্দী গত রাতে ভারতীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনায় বিষয়টি নিয়ে সরব হলেন। তাঁর কথায়, “ভারতে ওই ঘৃণাসূচক মন্তব্যের দশ দিন পরও ব্যবস্থা নেওয়া হযনি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী মুখ খোলেননি। যখন পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলি রোষ প্রকাশ শুরু করল, তখন ব্যবস্থা নেওয়া হল। কারণ, তাদের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য সম্পর্কে আঁচ পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। অথচ এখানে সংখ্যালঘুদের উপর সাম্প্রতিক অতীতে যা নিপীড়নের খবর এসেছে, হাসিনা সরকার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পদক্ষেপ করেছে। দোষীদের গ্রেফতার করেছে। এমন বিষয় ফেলে রাখলেই তুষের আগুনের মতো ছড়াতে থাকে।” সূত্রের খবর, সরকারি ভাবে এই ঘটনার নিন্দা করে বিবৃতি না দেওয়া হলেও আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক উপকমিটি কিছু দিন পর একটি বিবৃতি দিতে পারে। তবে খন্দকার জানিয়েছেন, পরিস্থিতির উপর আপাতত নজর রাখা হচ্ছে।
স্বাভাবিক ভাবেই গত বছর দুর্গাপুজোর সময় কুমিল্লায় অশান্তির প্রসঙ্গ উঠে এসেছে আলোচনায়। গোলাম খন্দকারের কথায়, “কুমিল্লায়, রংপুরের পীরগঞ্জে এই ধরনের খবর আসার এক দিনের মধ্যেই নিরাপত্তা বাহিনী ব্যবস্থা নিয়েছে। যারা গোলমাল পাকিয়েছিল, এমন জনা কুড়ি ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দু’জন গুলি চালাচালির মধ্যে পড়ে মারা গিয়েছে।” খন্দকার বলেন, ভারত সিএএ, এনআরসি আনার পরে এ দেশে তার কিছু প্রভাব পড়ে। কিন্তু শেখ হাসিনা ‘লৌহমুষ্টি’তে তার মোকাবিলা করেছিলেন।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর যে বিশেষ সেল রয়েছে, তার এক অফিসার বলছেন, “গত বছর মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যে অরাজকতা হয়েছিল, তার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের প্রত্যেকেই কারাগারে।”
ইসলামি ঐক্য জোটের নেতা মুফতি ফয়জুল্লার বক্তব্য, “মুক্তিযুদ্ধে পাশে দাঁড়ানোর জন্য আমরা ভারতের কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু এখন বেদনার সঙ্গে লক্ষ্য করছি, গোমাংস কিনেছে, এই সন্দেহেও ভারতে মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। সম্প্রতি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে চরম অবমাননা করে যে মন্তব্য করা হয়েছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক। এই ঘটনা শুধু মুসলমান সমাজ নয়, উদার, শান্তিপ্রিয়, মধ্যমপন্থী যে কোনও মানুষকে ক্ষতবিক্ষত করবে।” তাঁর কথায়, “বাংলাদেশে সংখ্যালঘু আক্রমণ হলে উলেমারা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করেন। ভারতে নবির উপর আঘাত এলে সে দেশের প্রত্যেক মানুষের নিন্দা করা উচিত।”
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং চাকরির পরিসরে সুযোগের অভাবের অভিযোগ নতুন নয়। কোভিডের আগে এ দেশে এসে, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের মুখে শুনেছি বিবিধ অভিযোগের স্বর। এ বারে কিন্তু অন্য সুরে কথা বললেন এই পরিষদের প্রেসিডেন্ট নিমচন্দ্র ভৌমিক। তাঁর বক্তব্য, “বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অবস্থার উন্নতি হয়েছে গত কয়েক বছরে। দেশের প্রশাসন এবং পুলিশ ব্যবস্থায় সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব বেড়েছে। সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা যে ঘটছে না তা নয়, কিন্তু দ্রুত তার মোকাবিলা করছে সরকার এবং প্রশাসন।’’ একই সুর এই পরিষদের খ্রিস্টান এবং বৌদ্ধ প্রতিনিধিদের মুখেও।
প্রশ্ন উঠছে, অন্য দেশগুলির সঙ্গে গলা মিলিয়ে হাসিনা সরকার নূপুর-কাণ্ডের নিন্দা করে বিবৃতি দিল না কেন? এখানকার রাজনৈতিক মহল বলছে, তার কারণ মূলত দু’টি। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বহু ঝড়ঝাপ্টার পর এখন আবার ‘সোনালি অধ্যায়ের’ মুখ দেখছে। রেল, স্থল, সমুদ্র এবং বাণিজ্য সংযোগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার মাত্রা বাড়ছে। এই বছরের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে আসার কথা। ওই সফরে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে আরও কিছু নতুন দিক খোলার সম্ভাবনা। ফলে এখন এমনিতেই কোণঠাসা মোদী সরকারকে বিদ্ধ করতে চাইছেন না শেখ হাসিনা, কূটনৈতিক কারণে। দ্বিতীয়ত, বিষয়টিতে বাংলাদেশও শামিল হয়ে গেলে এ দেশে মৌলবাদী, উগ্রপন্থী জামাত গ্রামেগঞ্জে রাস্তায় নেমে নৈরাজ্য তৈরি করতে পারে। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশে যত চর্চা হবে, রোষ তত বাড়তে পারে, এবং এখানকার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে সমস্যা হতে পারে বলে জানাচ্ছে ঢাকার সরকারি সূত্র। এই ঘটনার প্রতিবাদে শুক্রবার কিছু কট্টরপন্থী গোষ্ঠী মিছিলের পরিকল্পনা করেছে বলে সূত্রের খবর। তাদের বোঝানোর চেষ্টা চলছে।
সুত্র: আনন্দবাজার