পদ্মা সেতু প্রকল্পে লুটপাটের সর্বোচ্চ চর্চা করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি থেকে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা। বিএনপি নেত্রী বলেন, দেশে এখন উন্নয়ন অস্বীকার করার আইন করা প্রয়োজন। কারণ, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টও সরকারকে নিরাপত্তা দিতে পারছে না। তাই হলোকাস্ট ডিনায়াল অ্যাক্টের মতো উন্নয়ন অস্বীকার আইন করার পরামর্শ দেন রুমিন, যার মাধ্যমে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সমালোচকদের জেলে পুরে দেয়া আরও সহজ হবে।
বুধবার (৮ জুন) সংসদে পদ্মা সেতুর ওপর সাধারণ আলোচনায় এসব কথা বলেন তিনি।
রুমিন ফারহানা বলেন, সংসদটা অতিরিক্ত মিষ্টি হয়ে গেছে। বেশি মিষ্টি স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো নয়। সে জন্য আমি কিছু তেতো সত্য কথা বলব। যাতে অন্তত ভারসাম্যটা রক্ষা হয়। আর সেইসঙ্গে প্রদীপের নিচে অন্ধকারের দিকেও যেন আমরা একটু তাকাতে পারি।
তিনি বলেন, আমার বক্তব্যের শুরুতেই আমি একটি গল্প বলব। লিথুনিয়ার কৌনাস পৌরসভার মেয়র একটি শিপিং কনটেইনারের মধ্যে টয়লেট নির্মাণ করেছিলেন দেড় কোটি টাকার বিনিময়ে। কাছাকাছি একটি টেনিস ক্লাব একই ধরনের টয়লেট বানায় মাত্র সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ করে। মেয়রের ওই টয়লেট নির্মাণের অবিশ্বাস্য খরচের কারণে মানুষ মজা করে সেই টয়লেটকে বলতেন, সোনার টয়লেট। একই রকম কিংবা একটু বেশি দৈর্ঘ্যের অন্যান্য সেতুর সঙ্গে পদ্মা সেতুর বর্তমান ব্যয় তুলনা করলে, পদ্মা সেতুকে আমরা বলতেই পারি, আমাদের সোনার সেতু। যৌক্তিকভাবে অনুমান করি, কৌনাস সোনার টয়লেট মামলার পাশাপাশি বাংলাদেশ সোনার সেতু মামলাও দুর্নীতির উদাহরণ হয়ে থাকবে।
এ সময় পদ্মা সেতুর সঙ্গে ভারতের কয়েকটি সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের কথা তুলে ধরেন রুমিন ফারহানা। বলেন, পদ্মা বহুমুখী সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০১১ সালে। শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সালে। মূল প্রকল্পের পরিকল্পনা করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালে। সেই সময় ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকার বহুল আলোচিত পদ্মা প্রকল্প পাস হয়। পরে দুর্নীতির অভিযোগে যখন বিশ্বব্যাংক চলে যায়, তখন আওয়ামী লীগ পদ্মা সেতুর ভার নেয়। এরপর দফায় দফায় এর মেয়াদ বাড়ে। অর্থ বেড়ে সেটা ৩০ হাজার কোটি টাকা হয়। ভারত, চীন, মালয়েশিয়া, ব্রুনাইয়ের মতো দেশে প্রতি কিলোমিটার সেতু তৈরিতে খরচ পড়ে ৫০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা। বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক শামসুল হকের মতে, আমাদের মতো দেশে প্রতি কিলোমিটার শুধু সড়ক ব্যয় ৫০০ কোটি আর রেল সেতুসহ ৭০০ কোটি হতে পারে। তবে নদীর জটিল ভূপ্রকৃতি বিবেচনায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটা দ্বিগুণও হতে পারে। অর্থাৎ, রেল সেতুসহ সর্বোচ্চ ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা প্রতি কিলোমিটার হতে পারে। অথচ পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় প্রতি কিলোমিটার ৫ হাজার কোটি টাকা।
ফারহানা বলেন, ‘আমরা যদি ঘরের পাশে ভূপেন হাজারিকা সেতুর দিকে তাকাই, ৯ কিলোমিটার এই সেতুর নির্মাণ ব্যয় ১ হাজার ১০০ কোটি রুপি। অর্থাৎ, ভারতে একটা পদ্মা সেতু নির্মাণ ব্যয় দিয়ে ৩০টি ভূপেন হাজারিকা সেতু নির্মাণ সম্ভব। ভারতের কাচ্চি দরগা থেকে বিদুপুর পর্যন্ত গঙ্গা নদীর ওপারে ৬ লেনবিশিষ্ট ১০ কিলোমিটারের যে সেতু নির্মিত হচ্ছে, সেই সেতুর খরচ হচ্ছে ৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ, একটা পদ্মা সেতুর ব্যয়ে ভারতে ১০টি সেতু নির্মাণ সম্ভব। লুটপাট আর কাকে বলে!
রুমিন দাবি করেন, শুরুতে যখন পদ্মা সেতু পরিকল্পনা নেওয়া হয় তখন রেল পরিকল্পনায় ছিল না। কিন্তু পরে আওয়ামী লীগ রেল যুক্ত করে। দাম বেড়ে হয় ৩৯ হাজার২৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২১ হাজার ০৩৬ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে এক্সিম ব্যাংক অব চায়না, বাকিটা দেশের টাকা।
সরকার বহু টাকা নয় ছয় করে নষ্ট করার পরে পায়রাকে আর গভীর সমুদ্র বন্দর করেনি বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতুর মতো এত বড় প্রকল্পের জন্য পক্ষে লাভজনক শর্তে ঋণ নিতে না পারা সরকারের একটা বড় ব্যর্থতা। আজ এ সংসদে আলোচনা হয়েছে- বিশ্বব্যাংক আবার ফিরে এসেছিল। তাহলে বিশ্বব্যাংকে আবার নেওয়া হয়নি কেন? বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিলে জবাবদিহিতা থাকতে হয় এবং এ সরকার যে হরিলুট করেছে সেটা বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিয়ে সম্ভব হত না।
বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃত করে রুমিন বলেন, পদ্মা সেতুর রেল লাভজনক নয়। এটা যে আয় হবে সে তুলনায় ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ঢাকা ভাঙ্গা মাওয়া পার হয়ে পদ্মা সেতুতে যেতে হবে সে মহাসড়কটি ৫৫ কিলোমিটার সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে। অর্থাৎ মহাসড়কটি ব্যয় দুইশ কোটি টাকার ওপরে প্রতি কিলোমিটারে। যেখানে ইউরোপ আরেমিকায় প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হয় ৩০-৩৫ কোটি টাকা।
তিনি বলেন, গর্বের জায়গা হলো নিজের টাকায় সেতু তৈরি হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে ঋণের টাকায় যদি সেতু তৈরি হয় সেটি বুঝি নিজের টাকায় নয়? ঋণ দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করাটাই স্বার্থের অনুকূল। দিনে দিনে দায় শোধ করা যায়, এর মধ্যে সেতু থেকেও আয় শুরু হয়। প্রকল্প শেষে অর্থনীতিতে অবদান রাখতে শুরু করার পর তার দায় শোধ করাটাই মঙ্গলজনক।
সংসদের পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এ সংসদ সদস্য বলেন, কী বীভৎস অসহিষ্ণ সংসদ। এ পদ্মা সেতু নিয়ে টিকটক ভিডিও করার কারণে একজনকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় মামলা, গ্রেফতার ও রিমান্ডেও নেওয়া হয়। কথা কথায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা, গ্রেফতার, রিমান্ডে নেওয়ার আর কোনো বিষয় নয়। এখন আর এ সরকারকে খুব নিরাপত্তাও দিতে পারছে না উল্লেখ করে তিনি প্রস্তাব করেন, হলোকাস ডিনায়েল অ্যাক্টর মতো ডেভেলপমেন্ট ডিনালে অ্যাক্ট বা উন্নয়ন অস্বীকার আইন করা হোক।
তিনি আরও বলেন, যে আইনে সরকারের বয়ানের সঙ্গে যারা একমত না হবেন, লুটপাটের বিরুদ্ধে যারা বলবে, মানবাধিকারের কথা ও ভোটের অধিকারের কথা বলে, ন্যায় বিচারের কথা বলে তাদের ওই অ্যাক্টের আওতায় শাস্তি দিয়ে জেলেপুরে রাখা যাবে যতদিন খুশি ততদিন।
প্রধানমন্ত্রী চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন, কিন্তু অনেক প্রশ্ন আছে
বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ বলেন, পদ্মা সেতু একটি বিরাট অর্জন তাতে সন্দেহ নেই। প্রধানমন্ত্রী চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। কিন্তু অনেক প্রশ্ন আছে, বিশ্ব ব্যাংক কেন অর্থায়ন করেনি, দফায় দফায় ব্যয় বেড়েছে। এসবের স্বচ্ছতা জবাবদিহি দরকার। বড় বড় প্রকল্পগুলো নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে।
রুমিনের বক্তব্যের সময় সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা হইচই করার ঘটনার কথা উল্লেখ করে হারুন বলেন, সংসদে আলোচনা হবে। সরকারি দলের সদস্য বক্তব্য খণ্ডন করতে পারেন। কিন্তু যেভাবে হইচই হয়েছে, স্পিকার প্রটেকশন দেননি।
হারুন বলেন, পদ্মা সেতুর ফলে দক্ষিণাঞ্চলে উন্নয়নের মাইলফলক হবে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু রেল সেতু, এক্সপ্রেসওয়ে, লক্ষ কোটি টাকার মেগা প্রকল্প নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে।
হারুন বলেন, শাসকের সামনে সত্য বলা সবচেয়ে বড় জিহাদ। তারা সেই জিহাদ করছেন, সত্য বলছেন। মিথ্যা বলছেন।
পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধে বিএনপির ভূমিকা নিয়ে সরকার পক্ষের বক্তব্যের পাল্টায় হারুন বলেন, বিশ্ব ব্যাংক কি বিএনপির কথায় টাকা দেয়? বিএনপি বিরোধী দল, ক্ষমতাও নেই, বিএনপি কীভাবে টাকা বন্ধ করে দেয়?
বিকালে স্পিকার শিরীন শারমিনের সভাপতিত্বে সংসদের অধিবেশন শুরু হয়। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিতে আলোচনার প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন নূর ই আলম চৌধুরী।