অবশেষে দীর্ঘ ৬ বছর পর ফরিদপুরে আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ মুক্ত করা হয়েছে ফরিদপুর জেলাকে। নানা কারণে ফরিদপুরের সম্মেলন আলোচিত। বিশেষ করে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করার পর ফরিদপুরের রাজনীতিতে একটি ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে।
অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, ফরিদপুর আওয়ামী লীগের একটি প্রতীকী চিত্র। ফরিদপুরের রাজনীতির যেনো সারা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতির এক প্রতীক হয়ে উঠেছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ফরিদপুর থেকে মনোনয়ন পান ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর তিনি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এসময় মূল আওয়ামী লীগের বাইরে তিনি একটি প্যারালাল আওয়ামী লীগ গঠন করেন। বিএনপি-জামায়াত এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে লোকজনকে আওয়ামী লীগে জড়ো করেন। ফলে যারা দীর্ঘদিন ধরে ফরিদপুরে আওয়ামী লীগের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছে তারা কোণঠাসা হতে থাকেন। নানা রকম মামলা-হামলায় জর্জরিত হতে থাকেন। মূল আওয়ামী লীগ সেখানে বিরোধী দল। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াত থেকে আসা আওয়ামী লীগ সেখানে সরকারি দলে পরিণত হয়।
এরকম অবস্থা চলতে থাকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত। ২০১৯ সালের মন্ত্রিসভা ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এরপর আস্তে আস্তে ফরিদপুরের রাজনীতিতে রাজনৈতিক দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে থাকে। আস্তে আস্তে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের প্রভাব বলয় ফরিদপুরে খর্ব হতে থাকে। এরপর সামনে আসে ফরিদপুরের ছাত্রলীগের দুই নেতার হাজার কোটি টাকা পাচারের ঘটনা। এর মধ্য দিয়ে ফরিদপুরে রাজনীতিতে আস্তে আস্তে কোণঠাসা হতে থাকেন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। একপর্যায়ে তার এপিএস এবং সর্বশেষ তার ভাইকেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী অর্থপাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে। গতকাল যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেই সম্মেলনে মোশাররফপন্থী কাউকে দেখা যায়নি। তার নেতৃত্বে যে আওয়ামী লীগের বলয় গড়ে উঠেছিল, সেই বলয় ভেঙে গেছে। মোশাররফপন্থীরা এবার সম্মেলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ থেকে বাস্তবিক অর্থেই বিতাড়িত হয়েছেন। এর প্রেক্ষিতেই ফরিদপুরের রাজনীতি নিয়ে নতুন প্রশ্ন উঠেছে। ফরিদপুরের রাজনীতি এখন মোশাররফ মুক্ত হয়েছে।
এই সম্মেলনের মাধ্যমে শামিম হককে সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক পদে ইশতিয়াক আরিফকে নির্বাচিত করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠলো যে, ফরিদপুরের রাজনীতিতে মোশাররফপন্থীদের অপসারণের মধ্য দিয়ে কি আওয়ামী লীগ শক্তিশালী হলো? আওয়ামী লীগে বিভক্তি কি কেটে গেছে? একথা ঠিক ফরিদপুরের সম্মেলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সুস্পষ্ট একটি বার্তা দিয়েছে। সেই বার্তাটি হলো দলে অনুপ্রবেশকারী হাইব্রিডদের কোনো জায়গা নেই। তাদেরকে যেকোনোভাবেই দল এবারের কাউন্সিলের আগে প্রতিহত করতে চায়। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে বের করতে চায়। বরং দলের ত্যাগী, পরীক্ষিতদেরকে সামনে আনতে চায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের রাজনীতির আরেকটি চিত্র হলো বিভক্তি-অন্তর্কলহ। ফরিদপুরে আওয়ামী লীগ হাইব্রিড, অনুপ্রবেশকারী মুক্ত হয়েছে, কিন্তু বিভক্তি মুক্ত হয়েছে কি?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যাবে যে, এই সম্মেলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের কোন্দল এবং বিভক্তি কমেনি। বরং ফরিদপুরের রাজনীতিতে এখন মূল কোন্দল জায়গা সেখানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ এবং যুবলীগের নেতা মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন। এই দুইজনের বিরোধ ফরিদপুরের রাজনীতিতে একটি বড় ফ্যাক্টর। এই সম্মেলনে কাজী জাফরউল্লাহ উপস্থিত ছিলেন এবং কমিটি তিনি ঘোষণা করেন। অন্যদিকে মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন ফরিদপুরে রাজনীতিতে এখন বড় একটি ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছে। আর তাই ফরিদপুরের রাজনীতি মোশাররফ মুক্ত হলেও কোন্দল মুক্ত হয়নি বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
সৌজন্যে: বাংলাইনসাইডার