ফ্রিডম বাংলা নিউজ

মঙ্গলবার, জুলাই ৯, ২০২৪ |

EN

ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে যাচ্ছে ন্যাটো?

বিশ্ব বাংলা ডেস্ক | আপডেট: সোমবার, এপ্রিল ১৮, ২০২২

ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে যাচ্ছে ন্যাটো?
যখন কোনো দেশে যুদ্ধ বা লড়াই চলে তখন পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে যায়। দ্রুত গতিতে অর্থ শেষ হতে শুরু করে। গত ১৫ এপ্রিল যখন জার্মানির পক্ষ থেকে ঘোষণা আসে যে, তারা ইউক্রেনকে অতিরিক্ত সামরিক সহায়তায় প্রায় ১০০ কোটি ইউরো দেবে তখন অনেকেই কিছুটা অবাক হয়েছেন। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে এই অর্থও পানির মতো খরচ হয়ে যাবে। ইউক্রেনে যুদ্ধের জন্য ট্যাঙ্ক পাঠাতে জার্মানি ব্যর্থ হলেও এই বিপুল পরিমাণ সহায়তার ঘোষণা তাদের বিরুদ্ধে সমালোচনা অনেকটাই কমিয়ে এনেছে।

ইউক্রেনকে ভারী অস্ত্র দিয়ে সহায়তার যে প্রতিশ্রুতি সম্প্রতি দেওয়া হয়েছিল এটা তারই একটি অংশ। এর মাত্র দুদিন আগেই ৮০ কোটি ডলারের অতিরিক্ত সহায়তার ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই সহায়তার অনুমোদন দেন।

তিনি জানিয়েছিলেন যে, ইউক্রেনের পূর্বে রাশিয়ার প্রত্যাশিত ‘বৃহত্তর আক্রমণ’ মোকাবিলার জন্য তৈরি করা নতুন অস্ত্র এই সামরিক সহায়তায় অন্তর্ভুক্ত থাকবে। নতুন সহায়তার আওতায় ইউক্রেনে দূরপাল্লার কামান, উপকূল প্রতিরক্ষা ড্রোন, ভারি সাঁজোয়া যান, ট্যাঙ্ক, হেলিকপ্টার ও বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে সামরিক সহায়তার কিছু চালান ইউক্রেনে আসতে শুরু করেছে।

এদিকে ব্রিটেন সাঁজোয়া টহল যান এবং জাহাজ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র পাঠাচ্ছে। অপরদিকে চেক প্রজাতন্ত্র পুরোনো সোভিয়েত আমলের মোবাইল রকেট-লঞ্চার এবং টি-৭২ ট্যাঙ্ক সরবরাহ করেছে।

ইতোমধ্যেই ইউক্রেনকে একটি এস-৩০০ অ্যান্টি-এয়ারক্রাফ্ট সিস্টেম পাঠিয়েছে স্লোভাকিয়া। তারা জানিয়েছে যে, ইউক্রেনকে মিগ-২৯ যুদ্ধবিমানও সরবরাহ করা হবে। সোভিয়েত মডেলের এই যুদ্ধবিমান চালনায় ইউক্রেনীয় পাইলটরা বেশ দক্ষ।

মার্চের শুরুতে আমেরিকা পোল্যান্ড থেকে মিগ-২৯ সরবরাহের প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল। তখন আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল যে, ইউক্রেনকে সহায়তার জন্য রাশিয়াকে প্রতিশোধ গ্রহণে উস্কে দেওয়া হচ্ছে এবং এভাবেই হয়তো রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে পারে ন্যাটো। যদিও ন্যাটোর দাবি, ইউক্রেনকে অস্ত্র সহায়তা দেওয়া মানে এই নয় যে, তারা রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে।

এ বিষয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ অনেকটাই স্পষ্টবাদী। তিনি বরাবরই জোর দিয়ে বলে আসছেন যে, ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো থেকে ইউক্রেনকে ভারী অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করলে রাশিয়া হয়তো ন্যাটোকে এই যুদ্ধের সহযোদ্ধা বলে অ্যাখ্যা দিতে পারে।

সম্প্রতি ইউক্রেনকে ১৫৫ মিমি হাউইজারসহ বেশ কিছু অত্যাধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করবে যুক্তরাষ্ট্র, যা যুদ্ধে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপ অন্যদেশের জন্য খারাপ নজির স্থাপন করবে। মার্চের শেষ দিকে ইস্তাম্বুলে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানের হস্তক্ষেপে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে শান্তি আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সেসময় কিয়েভ থেকে সামরিক কার্যক্রম কমিয়ে আনার ব্যাপারে ইতিবাচক বার্তা দেয় রাশিয়া।

তাছাড়া ইউক্রেনের সমর্থনে পাঠানো সরবরাহ ব্যবস্থায় হামলার বিরুদ্ধে মস্কোকে সতর্ক করেন ন্যাটোর প্রধান জেন স্টলটেনবার্গ। তারপর এসব ক্ষেত্রে হামলা থেকে বিরত থাকে রাশিয়া। কিন্তু সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ বাড়িয়েছে। রাশিয়া তার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে ইউক্রেনের সেনাদের ভারী অস্ত্র থেকে বিরত রাখতে হামলা চালাতে পারে। ফলে সংকট আরও বাড়বে। ইউক্রেনকে দেওয়া সামরিক সহায়তার ফলে পরবর্তী শান্তি আলোচনাও এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে।

জেলেনস্কি সরকারকে সরবরাহ করা যুক্তরাষ্ট্রের ভারী অস্ত্র শুধু শান্তি আলোচনার অগ্রগতিকেই নষ্ট করবে না, সংঘাতকে আরও দীর্ঘস্থায়ী করবে। যদিও ওয়াশিংটন এমনটাই প্রত্যাশা করছে। এদিকে রাশিয়া চায় সীমিত পরিসরে তাদের কার্যক্রম চালাতে ও শান্তি আলোচনার মাধ্যমে বিতর্ক নিরসন করতে।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো চায়, এই যুদ্ধকে ব্যবহার করে মস্কোকে ফাঁদে ফেলতে। যা দীর্ঘমেয়াদে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা করতে পারে। একদিকে ইউক্রেনকে দেওয়া অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে অনিচ্ছুক, অন্যদিকে ন্যাটোকেও থামাতে চায় না যুক্তরাষ্ট্র। ফলে সংঘাত আরও দীর্ঘ হতে পারে বলে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্র জটিল কৌশল অবলম্বণ করছে। পশ্চিমারা ইউক্রেনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভাড়াটে যোদ্ধা পাঠিয়েছে এমন দাবিকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাছাড়া রাশিয়ার সম্প্রতি ডুবে যাওয়া জাহাজটির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের হাত রয়েছে এটাও নাকচ করে দেওয়া যায় না। এর ফলে রাশিয়াও প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হতে পারে। সামরিক সংঘাত হতে পারে দীর্ঘায়িত।

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করার পরও পেন্টাগন জানিয়েছে, ইউক্রেনে তাদের সামরিক সহায়তা অব্যাহত থাকবে। মস্কোর সতর্কতার বিষয়টি অবহেলার মানে দাঁড়ায় এ সংঘাতকে কাজে লাগিয়ে রাশিয়াকে ধ্বংস করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এ জন্য তারা স্বল্পমেয়াদে যুদ্ধ বিরতিও চায় না। রাশিয়ার উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করা ও সামরিক সক্ষমতাকে দুর্বল করতে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সংঘাতে জড়াচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে পশ্চিমাদের সরবরাহ ব্যবস্থাকে লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত করতে পারে রাশিয়া। এমন সিদ্ধান্তের ফলে ন্যাটো ও রাশিয়ার মধ্যে সংঘাত অবধারিত হতে পারে। এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি যেভাবে অবনতি হচ্ছে তাতে পারমাণবিক যুদ্ধও ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা মানবতার জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। যদিও কেউই এমন পরিস্থিতি দেখতে চাই না।

এখন আমেরিকা বলছে, স্লোভাকিয়ার প্রস্তাবে তাদের কোনো অভিযোগ নেই। সংঘাতের শুরুতে বন্ধু দেশগুলো ইউক্রেনকে ছোট অস্ত্র এবং বহনযোগ্য অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক ও বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেছে। কিন্তু যখনই এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, যুদ্ধ হয়তো দীর্ঘ হচ্ছে। তখন থেকেই তারা আরও বেশি অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে সহায়তা করতে আগ্রহী হয়ে উঠছে।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে যদ্ধাপরাধের অভিযোগ আগুনে ঘি ঢেলেছে। এর সুযোগে ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে দেশটিকে আরও বেশি সহায়তার সুযোগ নিচ্ছে বিভিন্ন দেশ। ফলে পুরোনো সোভিয়েত আমলের অস্ত্র থেকে শুরু করে ন্যাটোর আধুনিক অস্ত্র পাচ্ছে তারা। সোভিয়েত আমলের অস্ত্রের সঙ্গে ইউক্রেনীয় সেনারা বেশ পরিচিত আর আধুনিক অস্ত্রগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ এবং ব্যবহারও বেশ সহজ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার অবস্থান অবৈধ এবং অনৈতিক। তবে রাশিয়ার এই আক্রমণের অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ যেভাবে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে যাচ্ছে তাতে যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এতে করে সরাসরি সংঘাতের আশঙ্কা আরও বাড়ছে।

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, গ্লোবাল টাইমস