ফ্রিডম বাংলা নিউজ

রবিবার, সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৪ |

EN

বার বার ট্রেন দুর্ঘটনার দায় কার?

কলাম ডেস্ক | আপডেট: বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২, ২০২৩

বার বার ট্রেন দুর্ঘটনার দায় কার?
যাত্রাপথে সবচেয়ে আনন্দদায়ক উপায় হলো ট্রেন৷ দেশের একটা বড় অংশ ট্রেনেই চলাচল করে থাকে। এই ট্রেন যদি হয় দূর্ঘটনার শিকার তখন আনন্দদায়ক এই বাহনটি হয়ে ওঠে কষ্টের কারন। সম্প্রতি কিশোরগঞ্জের ভৈরবে যাত্রীবাহী ও মালবাহী দুটি ট্রেনের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাকে বলা যায় গত একদশকের মধ‍্যে সবচেয়ে বড় প্রানহানিকর দূর্ঘটনার মধ্যে একটি। দুর্ঘটনাটিতে সরকারি হিসেবে এখন পর্যন্ত ১৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছে আরো ৭৫ জনের বেশি।

কিশোরগঞ্জ থেকে আসা এগারোসিন্ধুর গোধূলি নামের একটি ট্রেন দুপুর সাড়ে তিনটার দিকে ইঞ্জিন বদল করার পর যখন জগন্নাথপুর রেল ক্রসিং পার হচ্ছিল, তখন ঢাকা থেকে আসা একটি মালবাহী ট্রেন ধাক্কা দিলে যাত্রীবাহী তিনটি বগি উল্টে যায়। শুধু এই দুর্ঘটনা নয় বাংলাদেশে আরো অনেক ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে যাতে বহু মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালে ৪০২টি রেল দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৩৯৬ জন নিহত হয়েছে। আর ২০২২ সালে ৬০৬টি রেল দুর্ঘটনায় ৫৫০ জন নিহত হয়েছে। তবে এই সংখ্যার মধ্যে রেলক্রসিংয়ের দুর্ঘটনাও রয়েছে। অন‍্যদিকে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৮ মাসে ১৪৩টি রেল দুর্ঘটনা সংগঠিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন।

বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট তথ্যসূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে যে ধীরগতিতে ট্রেন চলাচল করে, সেখানে লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটার জন্য রক্ষণাবেক্ষণের অভাবই দায়ী। রেলওয়ের রোলিং স্টক বা বাহনগুলো সব নতুন হওয়ার পরও এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশে রেললাইনের বেজ বা ভিত্তি ঠিক থাকে না, ভিত্তির লেভেল ঠিক থাকে না, নিচে যে উপাদানগুলো থাকে সেগুলো ঠিক সময়ে পরিবর্তন করা হয় না এবং জোড়াতালি দিয়ে রাখা হয়। এ কারণেই দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। দেশে রেল দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হচ্ছে দুর্বল ইঞ্জিন এবং সংস্কারবিহীন রেলপথ।

ট্রেন দুর্ঘটনার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং। রেলওয়ের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ২ হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার রেলপথে লেভেলক্রসিং আছে প্রায় ২ হাজার ৫৪১টি। প্রায় প্রতি কিলোমিটারে একটি করে লেভেল ক্রসিং আছে। এসব ক্রসিংয়ের মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশে কোনো গেট নেই বলে জানা যায়। বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট তথ্যসূত্রে জানা যায়, এসব লেভেলক্রসিংয়ের বেশিরভাগই অনুমোদন ছাড়া, যা জনগণের সুবিধার্থে তৈরি করা হয়েছে। লেভেল ক্রসিং অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ একটা জায়গা। প্রত্যেকটি লেভেলক্রসিংয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত জনবল না থাকায় বা দায়িত্ব পালনে অবহেলার জন্যও দেশে লেভেলক্রসিংয়ে অনেক দুর্ঘটনা ঘটছে।

বাংলাদেশের রেলওয়েতে লোকবলের সংকট ও দায়িত্ব পালনে কর্মচারীদের অবহেলা অন্যতম কারণ। যার ফলে দিন দিন দুর্ঘটনা ঘটার অভিযোগ আজ নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৩ সালে দেশে রেলের জনবল ছিল ৬৮ হাজার। ২০১৯ সালের দিকে এই সংখ্যা কমে এসে দাঁড়ায় ২৭ হাজারে। বর্তমানে ট্রেনের সংখ্যা বাড়লেও আশানুরূপ দক্ষ লোকবল তৈরি হয়নি। অভিজ্ঞ লোকোমাস্টার বা ট্রেনচালক যেমন দরকার, ঠিক তেমনি ট্রেনের শিফট বা শিডিউল যারা ব্যবস্থাপনা করেন, সেই স্টেশন মাস্টারও দরকার।

ট্রেনের নীতিমালায় বলা আছে যে, রেল ট্র্যাকের ১০ ফুটের মধ্যে সব সময় ১৪৪ ধারা জারি থাকবে অলিখিতভাবে। কেউ তার আশেপাশে আসতে পারবে না। তবে বাস্তবে এর উল্টোটা দেখা যায়।
দুর্ঘটনা রোধ করতে এসব অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে হবে এবং সেগুলো যাতে উঠিয়ে দেয়ার পর আবার বসতে না পারে তার জন্য সারা বছর ধরে তত্বাবধায়ন করতে হবে। এতে ব্যবহার করতে হবে রেলওয়ে পুলিশকে।

তবে এই রেলওয়ে পুলিশে রেলের কাজে নিয়োজিত থাকার কথা থাকলেও তারা আসলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত। ফলে তাদের পরিচালনার খরচ রেল মন্ত্রণালয় থেকে আসলেও তাদেরকে দিয়ে কাজ করাতে পারে না রেলওয়ে। এখানে এই জটিলতা এড়াতে রেলওয়ে পুলিশকে রেলমন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত করা উচিত বলেও মত দেন বিশেষজ্ঞরা। যখন একটি ট্রেন লাইনচ্যুত হয় বা ক্রসিং গ্রেড দুর্ঘটনায় জড়িত হয়, তখন ক্ষতি শুধুমাত্র আহত বা নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। অনেক ট্রেন দুর্ঘটনার ফলে আশেপাশের এলাকার পরিবেশ দূষিত হয়, যার জন্য ব্যাপক প্রতিকার ও পরিচ্ছন্নতার প্রয়োজন হয়। ট্রেন দুর্ঘটনার ফলে ব্যক্তি এবং সংস্থাগুলি উল্লেখযোগ্য সম্পত্তির ক্ষতি এবং আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। এমনকি ট্রেন দুর্ঘটনায় পরিবেশে বিষাক্ত পদার্থ নির্গত হওয়ার ফলে তারা আহত বা অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে।

রেলপথের এতসব বিশৃঙ্খলা এবং অব‍্যবস্থাপনার কারণেই কিছুদিন পর পর ঘটে চলেছে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনার ফলে জনগণের যাত্রা হচ্ছে অনিরাপদ।রেলের সঠিক ব‍্যবস্থাপনা আর রক্ষনাবেক্ষন করা না হলে ভবিষ্যতে এহেন দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে। এতে করে নিরাপদ এই বাহনে চলাচলে যাত্রীরা নিরুৎসাহিত হবে। তাই রেলের এই সমস‍্যাগুলো দ্রুত নিরসন করা জরুরী। সর্বোপরি রেলের সেবা বৃদ্ধির উপরেও জোর দেয়া উচিত।

স্পর্শ বনিক
শিক্ষার্থী, নাট্যকলা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।