ফ্রিডম বাংলা নিউজ

রবিবার, সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৪ |

EN

ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্রঐক্য কেনো প্রশ্নবিদ্ধ?

আরিফ ইশতিয়াক রাহুল | আপডেট: মঙ্গলবার, অক্টোবর ১৭, ২০২৩

ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্রঐক্য কেনো প্রশ্নবিদ্ধ?
গত ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ইং ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতৃত্বে ১৫ টি ছাত্রসংগঠনের সমন্বয়ে একটি নতুন জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে। যার নাম দেওয়া হয়েছে ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্রঐক্য। এই জোটভুক্ত ১৫ টি সংগঠন হলো জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ছাত্র ফেডারেশন (সাকি), ছাত্র অধিকার পরিষদ, ছাত্রলীগ (জেএসডি), গণতান্ত্রিক ছাত্রদল (এলডিপি), নাগরিক ছাত্র ঐক্য (মান্না), জাগপা ছাত্রলীগ, ছাত্র ফোরাম (মন্টু), ভাসানী ছাত্র পরিষদ, জাতীয় ছাত্র সমাজ (কাজী জাফর), জাতীয় ছাত্র সমাজ (পার্থ), জাগপা ছাত্রলীগ (খন্দকার লুৎফর), ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশ, বিপ্লবী ছাত্র সংহতি ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। এই জোটের সমন্বয়ক করা হয়েছে ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদ ইকবাল খান, ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মশিউর রহমান রিচার্ড ও ছাত্র অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আরিফুর রহমান আদীবকে। পাশাপাশি জোটভুক্ত সকল সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে কেন্দ্রীয় সমন্বয় পরিষদের সদস্য করা হয়েছে। আর এই জোটের মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করবে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল।


যদিও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সরকার পতনের আন্দোলনে বিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলোর জোটবদ্ধ হওয়া আলাদা তাৎপর্য বহন করে, কিন্তু ছাত্রদলের নেতৃত্বাধীন এই জোট ইতোমধ্যেই বেশকিছু বিতর্ক, বৈষম্য ও সংশয়ের জন্ম দিয়েছে। পাশাপাশি প্রশ্ন তৈরি হয়েছে এই জোটের ভারসাম্য ও সক্ষমতা নিয়েও। যার কারণে জোটের গ্রহণযোগ্যতা, সামর্থ্য ও সম্ভাবনা নিয়েই সৃষ্টি হয়েছে সংশয়।


ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্রঐক্য নিয়ে আলোচিত বিতর্কের মধ্যে অন্যতম বিতর্কিত বিষয় এর নাম। বাংলা ট্রিবিউনের মতে, ছাত্রদলের অতিত কর্মকাণ্ডের আলোকে এই জোটকে কতোটুকু ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্রঐক্য বলা যায় তা নিয়ে দ্বিধায় আছেন এই জোটেরই কিছু নেতা। ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের হত্যা, ধর্ষণ ও শিক্ষার্থী নির্যাতন ছাত্রদলের ফ্যাসিবাদী অতিতকেই মনে করায়। ছাত্রদল কর্তৃক বুয়েটে সনি হত্যা, মুহসিন হলের দখল নিতে মনির ও আসাদ গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলি, রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ওপর হামলা, ফটিকছড়িতে ২ ছাত্রলীগ কর্মীকে হত্যা, আশাশুনিতে গৃহবধূর স্তন কর্তন, শামসুন্নাহার হলে মেয়েদের নির্যাতনসহ অসংখ্য ঘটনা ছাত্রদলের ফ্যাসিবাদী অতিতকেই মনে করিয়ে দেয়। নিজেদের এই  ফ্যাসিবাদী অতিতকে আড়াল করে ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্রঐক্যের নেতৃত্ব দেওয়া অনেকেই ভালোভাবে দেখছেন না। 


ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্রঐক্যের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো অসম সংগঠনসমূহের জোটবদ্ধ হওয়া। বলে রাখা ভালো, ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্রঐক্যে জোটবদ্ধ হওয়া সংগঠনগুলোর অধিকাংশই নামমাত্র সংগঠন। যাদের বেশিরভাগ সংগঠনেরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় ও মহানগরে কোনো কমিটিই নেই। এমনকি কিছু সংগঠনের পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটিও নেই। গণঅভ্যুত্থান বা গণআন্দোলন গড়ে তোলা তো দূরের বিষয়, একটা ঘরোয়া কর্মসূচি পরিচালনা করার মতো লোকবলও এদের মধ্যে কিছু সংগঠনের নেই। ছাত্রঐক্য গঠন প্রক্রিয়ার শুরু থেকে এর সাথে যুক্ত থাকা বামপন্থী ও ধর্মভিত্তিক ছাত্রসংগঠনগুলোকে শেষ পর্যন্ত জোটে আনতে পারে নি বা নেয় নি জোটভুক্ত সংগঠনগুলো। এদের মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, ইসলামি ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত ছাত্র মজলিস ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসমাজ। জোটে থাকার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত জোটে নেই জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলন ও বাংলাদেশ ছাত্র মিশন। এই সংগঠনগুলোর জোটে না থাকার পক্ষে-বিপক্ষে বেশকিছু কথা প্রচলিত আছে।


এক্ষেত্রে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি দীপক শীলের যুগান্তরের কাছে করা একটি মন্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গত ২৯ আগস্ট ২০২৩ ইং যুগান্তরকে তিনি বলেন, 'তাদের (ছাত্রঐক্যের উদ্যোক্তা সংগঠন) সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, সাম্প্রদায়িক শক্তি বিশেষ করে আওয়ামী লীগবিরোধী সব শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে লড়াই করতে তারা আগ্রহী। আসলে এই লড়াইয়ের সঙ্গে আমরা একমত না।' দীপক শীলের এই মন্তব্যে একটি বিষয় পরিষ্কার। ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্রঐক্য কোনো ধরণের নৈতিক ভিত্তি বা আদর্শিক জায়গা থেকে সৃষ্ট জোট নয়। এই জোটের সদস্য হওয়ার একমাত্র শর্তই হলো আওয়ামী বিরোধীতা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে গঠিত ঐক্যফ্রন্টের অভিজ্ঞতা ও ফলাফল পর্যালোচনা করলে এই জোটের সাংগঠনিক ভারসাম্য, সকল সংগঠনের সমান গুরুত্ব ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নিয়েও অনেক প্রশ্নই থেকে যায়। একইসাথে আদর্শিক অবস্থা থেকে বিভাজিত রাজনীতিতে সম্পূর্ণ ভিন্ন আদর্শের দলসমূহের মধ্যে খুব বেশি কার্যকরী ও দীর্ঘস্থায়ী জোট গঠনের নজির বাংলাদেশে নেই। যদিও শেষ পর্যন্ত এই জোটেও ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট বা গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের মতো কট্টর বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোকেও ইসলামী ছাত্রশিবির, ইসলামি ছাত্র আন্দোলন বা খেলাফত ছাত্র মজলিসের মতো ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোর সাথে জোটবদ্ধ হতে দেখা যায় নি। 


এখানে আরেকটি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে ধর্মভিত্তিক ছাত্র সংগঠনগুলোর এই জোটে না থাকা; যারা ছিলো এই জোটের অন্যতম উদ্যোক্তা ও রূপকার। ধর্মভিত্তিক ছাত্রসংগঠনগুলোর দাবী, সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে সহাবস্থানে আপত্তি জানানো কট্টর বাম সংগঠনগুলো শেষ পর্যন্ত এই জোটে না থাকায় ধর্মভিত্তিক ছাত্রসংগঠনগুলোর সাথে জোট করতে আর কোনো আপত্তি বা নীতিগত বাঁধা ছিলো না। তবুও ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোকে বাদ দিয়ে ছাত্রঐক্যের আত্মপ্রকাশের ঘটনায় বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ এসব সংগঠনের নেতারা। ইসলামি শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের সভাপতি ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছেন, ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্রঐক্য ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করবে। অন্যদিকে সংগঠনটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি জামালুদ্দীন মুহাম্মাদ খালিদ ছাত্রদলের ডেকে নিয়ে গিয়ে পরবর্তীতে অসৌজন্যতা দেখিয়ে বাদ দেওয়াকেই উল্টো ফ্যাসিবাদের সাথে তুলনা করেছেন। উল্লেখ্য যে, এই জোটে ছাত্র জমিয়ত নামে একটি ধর্মভিত্তিক ছাত্রসংগঠনও আছে। অর্থাৎ ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্রঐক্যে বামপন্থী সকল ছাত্র সংগঠনও অনুপস্থিত নয়, ধর্মভিত্তিক সকল ছাত্রসংগঠনও অনুপস্থিত নয়। বামপন্থী সংগঠনও জোটে রাখা হয়েছে, ধর্মভিত্তিক সংগঠনও জোটে রাখা হয়েছে। কিন্তু সাংগঠনিকভাবে তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী ও পরিচিত কোনো সংগঠনকেই রাখা হয় নি। যা ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্রঐক্য গঠনের প্রক্রিয়া ও উদ্দেশ্যকেই প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। যেখানে শক্তিশালী ছাত্রআন্দোলন গড়ে তুলতে শক্তিশালী ছাত্রসংগঠনসমূহের জোট গঠন হওয়া প্রয়োজন সেখানে তুলনামূলকভাবে সাংগঠনিক শক্তিসম্পন্ন সংগঠন ব্যতিরেকে নামমাত্র সংগঠনসমূহের সাথে জোট গঠনকে ছাত্রদলের আন্দোলন গড়ে তোলার সদিচ্ছাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।


যদিও এর পেছনের সুস্পষ্ট কারণ জানা যায় নি, তবে নয়াদিগন্তের প্রতিবেদনসূত্রে জানা গেছে, গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা আ স ম আব্দুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না ও জোনায়েদ সাকিসহ বামপন্থী নেতারা চান, বেশি জনসম্পৃক্ততা আছে এমন ছাত্র সংগঠন যেনো এই জোটে না থাকে। সেক্ষেত্রে তাদের ছাত্রসংগঠনগুলো অস্তিত্বহীনতায় ভুগবে এবং জোটের নেতৃত্ব থেকে দূরে অবস্থান করবে।  এ জন্য তাদের প্রস্তাবেই তুলনামূলক বড় ছাত্রসংগঠনগুলোকে এই জোটের বাইরে রাখা হয়েছে। 


অন্যদিকে ছাত্রদলের মিত্রপক্ষের সমালোচনার পাশাপাশি এই জোটের সমালোচনা করছে ছাত্রদলের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ ছাত্রলীগও। নামসর্বস্ব ও অপরিচিত সংগঠনসমূহ নিয়ে জোট গঠন করায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।  ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্রঐক্যের প্রথম কর্মসূচি ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্র কনভেশনে নিজেদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনার কড়া সমালোচনাও করেছে তারা। পাশাপাশি ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্রঐক্য ছাত্ররাজনীতিতে বড় ধরণের আলোচনা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হওয়ায় এখন অনেকটাই নির্ভার ছাত্রলীগ। তবে তফসিলের এখনও ৩ সপ্তাহ ও নির্বাচনের ২ মাস বাকি। এর মধ্যে নিশ্চয় আরো অনেক ঘটনা ঘটবে। রোজকার রাজনীতি ও ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্রঐক্যের জল কোনদিকে গড়ায় তা দেখার জন্য আমাদের আরো অপেক্ষা করতে হবে। সময় বলে দেবে, এই জোট সফল নাকি ব্যর্থ।

কলাম লেখক- শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সহ-সম্পাদক, স্যার এ. এফ. রহমান হল ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মোবাইলঃ ০১৭১৮৮২৫৫৮৫