ফ্রিডম বাংলা নিউজ

রবিবার, সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৪ |

EN

গরিব কেন গরিবই থাকে?

কলাম ডেস্ক | আপডেট: শুক্রবার, সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৩

গরিব কেন গরিবই থাকে?
দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বর্ণবৈষম্য বিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার মতে, দারিদ্র্য ভিক্ষায় দূর হয় না, দূর হয় নায্যতায়।

ধরে নিন আপনি বেকার। মাসের পর মাস বিভিন্ন জায়গায় ঘুরছেন চাকুরির আশায়। বাড়ি থেকে আনা টাকায় কোনোরকমে বাড়ি ভাড়া, বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস বিল দিয়ে দুবেলা দুমুঠো খেয়ে বেঁচে আছেন। শেষমেশ, একটা চাকরি জুটিয়েই ফেললেন। মাসের প্রথম মাইনে পাওয়ার পর ভাবলেন সুদিন এসেছে। কিন্তু আসল খেলাটা এখানেই।

চাকরি পাওয়ার পর আগের তুলনায় আপনার হাত খরচ বেড়ে যায়। অফিসে যেতে গাড়ি ভাড়া থেকে শুরু করে ছুটির দিনে বন্ধুবান্ধবী কিংবা সহকর্মীদের সাথে রেস্টুরেন্টের আড্ডায় মেতে উঠা। এরপর দেখলেন যে বেকার থাকার সময় আপনার কাছে যাওবা টাকা-পয়সা থাকতো এখন তার চেয়েও কম থাকছে।
অর্থনীতিবিদদের ভাষায় এই দুরবস্থাকেই বলা হয় ‘কল্যাণ ফাঁদ’ (Welfare Trap)। যা মূলত একধরণের ‘দারিদ্র্য ফাঁদ’। আগে জেনে নেয়া যাক, দারিদ্র্য ফাঁদ কী?  

দারিদ্র্যের ফাঁদ এমন একটি পরিস্থিতি যেখানে কারো জন্য দারিদ্র্য থেকে পালানোটা বেশ কঠিন। কারণ স্বল্প আয় এবং সীমিত সুযোগের মতো কারণগুলি তার আর্থিক অবস্থার উন্নতি করাকে চ্যালেঞ্জিং করে তোলে। দারিদ্র্যের ফাঁদ হল একটি অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত পরিস্থিতি। এতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম মানুষ দরিদ্রই থেকে যায়। কিছু দারিদ্র্যের ফাঁদ একজন ব্যক্তির পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির সাথে যুক্ত, যেমন পুষ্টিকর খাবার বা শিক্ষার অভাব। আর সমগ্র জাতিকে প্রভাবিত করতে পারে এমন দারিদ্র্য ফাঁদও রয়েছে, যেমন দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের চক্র বা জলবায়ু পরিবর্তন।

কল্যাণ ফাঁদের তত্ত্বানুযায়ী কর এবং কল্যাণ ব্যবস্থা একসাথে কাজ করলে মানুষ অধিক আয় করার প্রতি অনুৎসাহিত থাকে। যখন কেউ কম বেতনের চাকরি করে তখন সে আয়-পরীক্ষিত সহায়তা হারিয়ে ফেলে। এর মানে কী দাঁড়ায়?

‘আয়-পরীক্ষিত সহায়তা’ বলতে ব্যক্তি বা পরিবারকে তাদের আয়ের স্তরের উপর ভিত্তি করে প্রদত্ত আর্থিক সহায়তাকে বোঝায়। যদি আপনার আয় একটি নির্দিষ্ট থ্রেশহোল্ডের নিচে হয়, তাহলে আপনি এই ধরনের সাহায্যের জন্য আবেদন করতে পারেন।

সহজ করে বলছি ‘বেকার ভাতা’। সম্প্রতি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় 'কর্মসংস্থান নীতি-২০২২' নামে একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছে। যারা কাজ করতে চান কিন্তু চাকরি খুঁজে পাচ্ছেন না তাদের সাহায্য করার জন্য বেকার ভাতা চালু করার প্রস্তাব দিয়েছে।
এটাও কিন্তু আদতে একটা কল্যাণ ফাঁদ। কীভাবে? দেখুন বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ এ ফাঁদে পা দিচ্ছে। বিশেষ করে কল্যাণ ফাঁদের নিষ্ঠুর পরিহাস হলো যে এটা মূলট দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করার জন্য ডিজাইন করা নীতিগুলি থেকেই উদ্ভূত। ইতিহাসের বেশিরভাগ সমাজব্যবস্থাই দরিদ্র মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য কিছু না কিছু ব্যবস্থা করেছে। বিংশ শতকের পূর্বে ধর্মীয় গোষ্ঠী এবং বেসরকারি কল্যাণ সংস্থাগুলোই এমন ব্যবস্থার জন্য উদ্যেগ গ্রহণ করতো।

এযুগে এ ধরণেই ব্যবস্থাকেই বলায় হয় কল্যাণমূলক কর্মসূচি। যেমন, সরকারি আবাসন, খাদ্য ব্যবস্থা ও চিকিৎসা সেবা। এগুলো কিন্তু আয়-পরীক্ষিত সহায়তা। অর্থাৎ, শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট আয়ের স্তরের নিচে থাকা লোকেরাই এই সুবিধা পাবে। এই নীতি গ্রহণ করা হয় যাতে করে যাদের সহায়তা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তারাই যেন পায়। এর অন্য অর্থও রয়েছে। যোগ্যতার থ্রেশহোল্ডের চেয়ে বেশি উপার্জন করার সাথে সাথে লোকেরা এ সুযোগ হারাবে। এতে তাদের কাছে টাকা থাকুক বা না থাকুক, কারও কিছুই আসে যায় না তাতে।

এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের মতে, ২০১৯ সালে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ২০.৫ শতাংশ মানুষই জাতীয় দারিদ্র্যসীমার নিচে দেখা গেছে। বিশ্বব্যাংক অনুমান করেছে যে কোভিড-১৯ মহামারী ৭১-১০০ মিলিয়ন মানুষকে চরম দারিদ্রের দিকে ঠেলে দিয়েছে। নতুন দরিদ্র বেড়েছে। অর্থাৎ যারা মহামারীর আগে দরিদ্র ছিল না তারাও এখন দারিদ্র্যসীমার নীচে নেমে গেছে। ঢাকা ট্রিবিউনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ৩৫ মিলিয়ন বাংলাদেশি এখনও দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে। তবে সাম্প্রতিক ইতিহাসে বাংলাদেশে দারিদ্র্য দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। স্বাধীনতার পরপরই, প্রায় ৯০ শতাংশ জনসংখ্যা দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল দেখা গেছে। ১৯৭২ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা দিনে ১ দশমিক ৯০ মার্কিন ডলার আয় করে এমন মানুষের হার ৯০ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশে নেমে এসেছে। পারিবারিক আয় ও ব্যয় সমীক্ষা অনুসারে ২০১৬ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৮৬.৯ শতাংশ, যা ২০২২ সালে কমে ১৮.৭% হয়েছে। জরিপে আরও দেখা গেছে যে দেশে চরম দারিদ্র্যের সামগ্রিক হার ৫.৬ শতাংশ। এর মধ্যে যা গ্রামীণ এলাকায় রয়েছে ৬.৫ শতাংশ এবং শহরে  রয়েছে ৩.৮ শতাংশ।
কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে দেশের শীর্ষ উন্নয়ন অগ্রাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্বব্যাংক। এটি অর্জনের জন্য, বাংলাদেশকে নির্ভরযোগ্য এবং সাশ্রয়ী মূল্যের বিদ্যুতের কম অ্যাক্সেস, দুর্বল পরিবহন অবকাঠামো, পরিসেবাযুক্ত জমির সীমিত প্রাপ্যতা, অনিশ্চিত এবং জটিল ব্যবসায়িক নিয়ন্ত্রণ, দ্রুত নগরায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকির কারণে উচ্চ প্রবৃদ্ধির বাধা দূর করতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের দারিদ্র্য নিরসনের কৌশলের মূল লক্ষ্য হল উৎপাদন বৃদ্ধি জোরদার করা এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। দারিদ্র্য কমাতে সরকার মানবসম্পদ উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা এবং সামাজিক কল্যাণে মনোযোগ দিয়েছে।

দরিদ্র এবং অ-দরিদ্র উভয়ের জন্যই এই দুষ্টু চক্র বেশ ক্ষতিকর। মূলধারার অর্থনৈতিক মডেলগুলি ধরেই নেয় যে জনগণ যুক্তিবাদী। তারা তাদের বিকল্প ব্যয় এবং সুবিধাগুলি বিবেচনা করে এবং জীবনে এগিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে সুবিধাজনক পথ বেছে নেয়। যারা দারিদ্র তারা যদি জানে যে তারা কাজ করে কোন নীট সুবিধা পাবে না, তবে তারা সরকারী সহায়তায় বাঁচতেই উৎসাহিত হবে।

অবশ্য, মানুষ সামাজিক নিয়ম এবং ব্যক্তিগত মূল্যবোধ থেকেও কাজ করে। তবে এতে প্রধান উদ্দেশ্য থাকে টাকা কামানো। আর যত কম মানুষ নতুন নতুন চাকুরি করবে, ততই অর্থনীতি গতি হারাবে। এতে মানুষ গরীবই থেকে যাবে। অনেকের ধারণা এই চক্র থেকে মুক্তি পেতে হলে কোনো প্রকার সরকারি সহায়তা রাখা যাবে না। কিন্তু অধিকাংশেরই মত, এটা কোনো বাস্তববাদী বা মানবিক সমাধান না। তাহলে আমরা কীভাবে সুবিধা প্রদান করতে পারি যাতে করে কাজ করাটা মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে না দাঁড়ায়। 
বহুদেশ এই সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে বহু উপায়ে চেষ্টা করেছে। কেউ কেউ চাকরি পাবার পরও একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সরকারি সুবিধা গ্রহণের অনুমতি দেয়। তবে আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে ধীরে ধীরে সুবিধাগুলি বন্ধ করে দেয়। এই নীতিগুলির কারণে কাজ করার জন্য আর্থিক প্রণোদনা থাকে না, তবে কল্যাণ ফাঁদের থেকে এর ঝুঁকি কিছুটা হলেও কম।  অন্যান্য সরকার তাদের সকল নাগরিকের জন্য সমানভাবে শিক্ষা, শিশু যত্ন বা চিকিৎসা সেবা প্রদান করে। 

একটি প্রস্তাবিত সমাধান সর্বজনীন সুবিধার এই ধারণাটিকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়। একটি সর্বজনীন মৌলিক আয় বা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। সম্পদশালী বা আভিজাত নির্বিশেষে সমাজের সকল সদস্যের জন্য একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় সুবিধা প্রদান করা।
এটি একমাত্র পরিচিত নীতি যা সম্পূর্ণরূপে কল্যাণ ফাঁদ অপসারণ করতে পারে। কারণ এতে অর্জিত মজুরির পরিপূরক হবে রাষ্ট্রীয় সুবিধা। এতে করে একটি স্থিতিশীল আয়ের তল তৈরি হবে। এতে করে কেউ এই আয়সীমার নিচে থাকবে না। দারিদ্র্য চক্র বাধাগ্রস্থ হবে।

১৮ শতক থেকেই বহু অর্থনীতিবিদ এবং চিন্তাবিদ এই ধারণা নিয়ে যুক্তি-পাল্টাযুক্তি দিয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে সর্বজনীন মৌলিক আয় ধারণাটি বেশ প্রকল্পিত। অনেক যায়গায় অবশ্য সীমতি ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ দেখা গেছে। তবে, এই স্থানীয় পরীক্ষাগুলি আমাদের পুরো দেশ জুড়ে কিংবা বিশ্বজুড়ে নীতিটি কীভাবে কার্যকর হবে সে সম্পর্কে আমাদের বেশি কিছু বলে না। 
সরকার যে কৌশলই অনুসরণ করুক না কেন, কল্যাণ ফাঁদ সমাধানের জন্য সমাজকে জনগণের আত্মসংস্থা এবং স্বাবলম্বীতাকে সম্মান করতে হবে। এদেশে দারিদ্র্যের চক্র ভাঙ্গার জন্য, জনগণকে তাদের জীবন এবং জাতির দীর্ঘস্থায়ী উন্নতি করার ক্ষমতা অর্জনে সহায়তা করতে হবে।

নাইমুর রহমান ইমন 
২য় বর্ষ
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।