ফ্রিডমবাংলানিউজ ডেস্ক | আপডেট: বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ৭, ২০২১
বলিউডে
মাদকের বিস্তার নতুন কোনো ঘটনা নয়। এর পাশাপাশি স্বজনপ্রীতি, পক্ষপাতিত্ব, বর্ণবাদ
থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা, বিশেষ করে মাফিয়াদের সঙ্গে
অনেক বলিউড তারকার সুসম্পর্ক বারবারই আলোচনায় এনেছে বিশ্বের অন্যতম বড় এই সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে।
গত বছর বলিউড তারকা সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে নতুন করে আলোচনায়
আসে এই ইন্ডাস্ট্রির মাদক সংস্কৃতি, যা আরও বেগ পেয়েছে সম্প্রতি বলিউড সুপারস্টার শাহরুখ
খানের ছেলে আরিয়ান খান মাদকসহ ধরা পড়ার পর।
সম্প্রতি
মুম্বাইয়ে একটি প্রমোদতরীর পার্টিতে মাদক সেবনের অভিযোগে ভারতীয় মাদক নিয়ন্ত্রক সংস্থার
(এনসিবি) হাতে আটক হন শাহরুখ পুত্র আরিয়ান। তাঁর বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ মাদক সেবনের অভিযোগ
এনে এনসিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ওই পার্টিতে নিষিদ্ধ মাদক ব্যবহারের খবর পেয়ে যাত্রীর
ছদ্মবেশে সেখানে অভিযান চালানো হয়। পার্টি থেকে কোকেন, হাশিশ, এমডিএমের মতো মাদকসহ
আরিয়ানসহ ১০ জনকে আটক করা হয়। এর পর জিজ্ঞাসাবাদে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন
আরিয়ান খান।
এনসিবির
বরাত দিয়ে ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম বলছে, প্রায় ছয় ঘণ্টা জেরার পর আরিয়ান স্বীকার করেছেন,
প্রমোদতরীর পার্টিতে তিনি মাদক নিয়েছেন। এ ছাড়া শাহরুখ-পুত্রের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট খতিয়ে
দেখে তিনি কার কার সঙ্গে কথা বলতেন, যোগাযোগ রাখতেন বা কোনো মাদকচক্রের সঙ্গে তিনি
যুক্ত কি না, সেসব বিষয়ও জানার চেষ্টা করছে এনসিবি। এ জন্য তাঁর জামিন আবেদনও নাকচ
করেছেন মুম্বাইয়ের একটি আদালত। ৭ অক্টোবর পর্যন্ত এনসিবির হেফাজতেই থাকতে হচ্ছে আরিয়ানকে।
বলিউড ও মাফিয়া
বলা
হয়ে থাকে মাদক বলিউড তারকাদের জীবনযাপনেরই অংশ, যা বর্তমানে ভয়াবহ ব্যাধির রূপ নিয়েছে।
তবে এ নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। যদিও এই ব্যাধিটা এক দিনে জেঁকে বসেনি। ১৯৭০ সালে
ভারত সরকার চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ তোলা বন্ধ করে দেয়। কারণ, বলিউডকে
তখনো ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে গণ্য করা হতো না। এর ফলে বিনিয়োগের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে বিপাকে
পড়েন পরিচালকেরা। আর সেই সুযোগ কাজে লাগায় মাফিয়ারা। তাদের কাছে কালো টাকার অভাব ছিল
না। ফলে ভারতের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে তারা প্রচুর বিনিয়োগ শুরু করে। এর মধ্য দিয়ে অবৈধ
টাকা দ্রুত সময়ের মধ্যে বৈধ উপায়ে ফিরতে শুরু করে মাফিয়াদের হাতে। আর এভাবেই বলিউড
হয়ে ওঠে ভারতের অন্যতম লোভনীয় ব্যবসা।
বলিউডের
সঙ্গে মাফিয়াদের যোগাযোগ শুরু হয় মূলত হাজি মাস্তানের আমল থেকে, যার পুরো নাম মাস্তান
হায়দার মির্জা। এক সময় মুম্বাইয়ের শীর্ষ এই ডন নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেন তখনকার বলিউড
ইন্ডাস্ট্রি। দিলীপ কুমার থেকে শুরু করে সেই সময়কার সব সুপারস্টারই ছিল তাঁর বন্ধু
তালিকায়। ফলে রাতারাতি সেলিব্রেটি গ্যাংস্টার বনে যান হাজি মাস্তান। তবে নিজের বলিউডকেন্দ্রিক
ব্যবসায় কখনো মাদক সংশ্লিষ্টতা রাখেননি তিনি। যদিও নিজের এই ‘ক্লিন ইমেজ’
বেশি দিন ধরে রাখতে পারেননি হায়দার মির্জা।
কারণ,
হাজি মাস্তানের হাত ধরেই জন্ম হয় আরেক মাফিয়া দাউদ ইব্রাহিমের। হাজি মাস্তান বলিউড
তারকাদের সঙ্গে কেবল ভালো সম্পর্ক রেখেই ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার চিন্তা করলেও এসব গণ্ডি
ছাড়িয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল দাউদের। সেই পরিকল্পনা থেকেই হাজি মাস্তানের মৃত্যুর পর
মাদক চোরাচালান শুরু করেন দাউদ ইব্রাহিম, যেখানে বিনিয়োগের বিনিময়ে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের
ব্যবহার করতে থাকেন তিনি। আশির দশক থেকে শুরু হয় দাউদের রাজত্ব। প্রভাব বিস্তার করতে
থাকে ‘ডি কোম্পানি’। আর সেখান থেকেই মুম্বাইয়ে গড়ে ওঠে একটি
বিশাল মাদক চক্র, যার প্রভাব এখনো দৃশ্যমান।
গত
বছরের ১৪ জুন ভারতের মুম্বাইয়ের একটি ফ্ল্যাট থেকে বলিউড অভিনেতা সুশান্ত সিংহ রাজপুতের
ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। আদালতের নির্দেশে তদন্তভার পায় দেশটির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা
সংস্থা সিবিআই। সুশান্তের আত্মহত্যার তদন্ত করতে গিয়ে একপর্যায়ে পাওয়া যায় একাধিক বলিউড
তারকার মাদক সংশ্লিষ্টতার তথ্য। এর পর থেকেই বলিউডে মাদকের বিস্তার নিয়ে তদন্ত শুরু
করে এনসিবি।
এই
মামলার প্রধান অভিযুক্ত ও সুশান্তের প্রেমিকা রিয়া চক্রবর্তীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তদন্তকারীরা।
সে সময় বহু বলিউড সেলিব্রিটির মাদক সম্পৃক্ততা খুঁজে পান, যারা প্রত্যেকেই প্রত্যক্ষ
বা পরোক্ষভাবে মাদক সেবন কিংবা সরবরাহের সঙ্গে জড়িত। তদন্ত চলাকালে এনসিবির কর্মকর্তারা
বলিউডের সঙ্গে মাদক চক্রের যোগসূত্রের সন্ধান পান পাঞ্জাবের অমৃতসর ও পাকিস্তানে। তালিকায়
রয়েছে কম্বোডিয়া ও আফগানিস্তানের নামও। আর সীমান্তের ওপার থেকে মুম্বাইয়ে বেআইনিভাবে
আসা কোকেন, হেরোইন, এমডিএমসহ একাধিক নিষিদ্ধ মাদক সংগ্রহ করেন বলিউডের অনেক সেলিব্রেটি।
ভারতের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থার দাবি, পাকিস্তানের পাঞ্জাব থেকে বিদেশে রপ্তানি করা
মাদকের টাকা ভারতে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ পরিচালনায় ব্যয় করে পাকিস্তান।
শেষ কোথায়
বলিউডের
সঙ্গে মাদকের যে দীর্ঘ সম্পর্ক রয়েছে, সে বিষয়ে তেমন কোনো দ্বিমত নেই। তবে এই মাদক
চক্রের শেষ কোথায়, সেই প্রশ্নও এখন মুখে মুখে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারতে অধিকাংশ টাকার
লেনদেন হয় মাফিয়া কর্মকাণ্ড, বলিউড, ক্রিকেট ও রাজনীতিকে কেন্দ্র করে। সে ক্ষেত্রে
বলিউড অঙ্গনে মাদকের অপব্যবহার কতটা বিস্তৃত এবং এই মাদকের টাকাই আবার চলচ্চিত্র প্রযোজনায়
ব্যয় করা হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখলেই বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে।
গত
বছর থেকে বলিউড তারকাদের মাদক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে তদন্ত শুরুর পর ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও
এখন ব্যস্ত সময় পার করছে মাদকের টাকার উৎস সন্ধানে। ধারণা করা যায়, এ জন্য জনপ্রিয়
প্রবাদ ‘ফলো দ্য মানি’ নিয়মই অনুসরণ করছেন ভারতীয় মাদক নিয়ন্ত্রক
সংস্থার কর্মকর্তারা।
কেবল
মুম্বাই নয়, ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলোর শোবিজ অঙ্গনে মাদকের প্রভাব কেমন, তার কোনো
সঠিক তথ্য-উপাত্ত নেই পুলিশ বা গোয়েন্দাদের কাছে। তবে এ বিষয়ে নজরদারি বাড়ানোর দাবি
উঠতে শুরু করেছে। কারণ, দ্রুতই মাদকের সঙ্গে সংস্কৃতির চর্চা করা মানুষদের এই সম্পর্ক
নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে ভারতকে চড়া মূল্য দিতে হতে পারে বলে শঙ্কা
অনেকের।