ফ্রিডম বাংলা নিউজ

রবিবার, সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৪ |

EN

নানা সংকটে বন্ধ বেগমগঞ্জ-চৌমুহনীর ৩২ সরিষা তেলের মিল

জেলা প্রতিনিধি | আপডেট: বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ৫, ২০২৩

নানা সংকটে বন্ধ বেগমগঞ্জ-চৌমুহনীর ৩২ সরিষা তেলের মিল
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনী হলো জেলার প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এটি খালের মোহনায় হওয়ায় এর নাম চৌমুহনী। বর্তমানে দৈনিক ৫০০ থেকে ১ হাজার কোটি টাকা লেনদেন লেনদেন হচ্ছে এই বাণিজ্যিক শহরটিতে।

স্থানীয়রা বলছেন, মূলত ব্রিটিশ-শাসনামলে এই বাণিজ্যকেন্দ্রটি গড়ে উঠেছে। স্বাধীনতার আগে-পরে এই অঞ্চলে মানুষেরা সরিষা তেলের ওপর প্রায় নির্ভরশীল ছিল। নিজেদের উৎপাদিত সরিষা তেল দিয়েই রান্না থেকে শুরু করে সব খাবার আয়োজন হতো। ব্রিটিশ সময়ের পর বৃহত্তর নোয়াখালীর (নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী) একমাত্র বাণিজ্যিক কেন্দ্র বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনীতে গড়ে উঠে ৩৭টি সরিষা তেলের ঘানি। এর মধ্যে ৩২টি বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে ৪-৫টি মিল কোনো রকম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে।

চৌমুহনী বাজার ঘুরে সরিষা ঘানি মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাজার জোড়া কাঠের ঘানির খট খট শব্দ এক সময় চৌমুহনীর মানুষের কাছে ছিল ছন্দের মতো। শ্রমিক আর ক্রেতাদের পদচারণায় মুখর থাকতো এখানকার সরিষা তেলের মিল বা ঘানিগুলো। স্বাধীনতার আগে এবং পরে দেশের প্রায় সব বাজারই ছিল চৌমুহনীর সরিষা তেলের দখলে। গুণে ও মানে প্রসিদ্ধ থাকলেও বর্তমানে ঐতিহ্য হারিয়েছে এখানকার সবকটি ঘানি।

মুক্তিযুদ্ধপূর্ব ও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশের বাজারে মানে ও গুণে প্রসিদ্ধ ছিল নোয়াখালীর বাণিজ্যকেন্দ্র চৌমুহনীর ঘানিভাঙা সরিষা তেল। যাদের মধ্যে অন্যতম ছিল, শ্রী গোবিন্দ অয়েল মিলস, শ্রী দুর্গা অয়েল মিলস, আদর্শ অয়েল মিলস, মতি অয়েল, গৌর অয়েল মিলস, নবযুগ অয়েল মিলস, মেঘনা অয়েল মিলস, শ্রী গোপাল অয়েল মিলস, ডালিয়া অয়েল মিলস, আজমীর অয়েল মিলস, গণেশ অয়েল মিলস, যমুনা অয়েল মিলস, বাল্ব মার্কা অয়েল, পপুলার অয়েল মিলস ও রোকেয়া অয়েল মিলস। প্রায় ৫০ বছরের এ শিল্প এখন বিলুপ্তপ্রায়।

সয়াবিন তেলের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতা, পুঁজি আর কাঁচামাল সংকটকে বন্ধ হচ্ছে মিলগুলো। ১৯৯০ পর থেকে মালিক পরিবর্তনসহ বিভিন্ন সংকট বন্ধ হয়েছে ৩২টি সরিষা তেলের ঘানি। চৌমুহনীতে বর্তমানে চালু রয়েছে, নবযুগ অয়েল মিলস, বাল্ব মার্কা অয়েল, রোকেয়া অয়েল মিলস ও শ্রী গোপাল অয়েল মিলস।

তারা আরও জানান, মিলগুলো চালু থাকলে গ্রাহকের চাহিদা হিসেবে সে পরিমাণ তেল উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না।

তাদের দেওয়া তথ্য মতে, বর্তমানে জেলায় সরিষা তেলের চাহিদা রয়েছে প্রতিদিন ১৫ হাজার কেজির বেশি। কিন্তু সে তুলনায় ৪টি ঘানিতে উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৩ হাজার ৫শ কেজি সরিষা তেল, যা চাহিদার মাত্র চার ভাগের এক ভাগ। যার ফলে ঢাকা, ফেনী ও লাকসামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ও বড় বড় ব্যান্ডের তেলগুলো দিয়ে জেলার চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। বর্তমানে ঘানিগুলো থেকে উৎপাদিত তেল প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ২৩০ টাকা করে। প্রতিমাসে সাড়ে ১০ কোটি টাকার তেলের চাহিদা থাকলেও সেই হিসেবে চারটি ঘানিতে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র আড়াই কোটি টাকার সরিষা। সরকারি সহযোগিতা ফেলে সরিষার এই চাহিদার পুরোটাই জেলার ঘানিগুলোতে উৎপাদিত তেল দিয়ে সম্ভব হতো, এর বাইরে এখানে উৎপাদিত তেল জেলার বাইরে বিক্রি করা সম্ভব বলে মনে করছেন তারা।

সচেতন মহল বলছে, দেশের কৃষিতে সরিষার আবাদ বাড়ানোর পাশাপাশি তেল উৎপাদনে মিলগুলো সচল রাখতে সরকারি নজরদারি বাড়ালে উৎপাদক উদ্যোক্তাদের হাত ধরে ঘুরে দাঁড়াবে এ শিল্পটি। 

মেঘনা অয়েল মিলসের পরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া মাহিন জানান, ২০০৭ সালে মিলসের দায়িত্ব নেওয়ার পর ২৬ জোড়া ঘানি মেশিন নিয়ে সরিষা তেল উৎপাদন শুরু করেন। তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন প্রায় ৮০ জন শ্রমিক। প্রথম দিকে প্রতিদিন ২ হাজার ৫০০ কেজি সরিষার তেল উৎপাদন এবং বিক্রি হতো। ২০১০ সালের দিকে এসে বাজারে সয়াবিন তেল আসার পর কমতে থাকে সরিষা তেলের চাহিদা। ২০১৯ সালের দিকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে কমতে থাকে কাঁচা (সরিষা) মাল আমদানি। একই সঙ্গে উৎপাদন কমতে থাকায় ছাঁটাই করা হয় শ্রমিকদের। ২০১৯ এরা মাঝামাঝি সময় একবারে বন্ধ করে দেওয়া হয় মিলটি।

তিনি আরও জানান, করোনাকালীন সয়াবিন তেলে মানবদেহের ক্ষতির বিষয়টি জানার পর ২০২১ সালের শেষের দিকে মানুষের মধ্যে সরিষা তেলের চাহিদা বাড়তে থাকে। কিন্তু মানুষের মধ্যে চাহিদা বাড়লে বাড়ছে না তেলের উৎপাদন। গ্রাহকের চাহিদার ভিত্তিতে মেঘনা অয়েল মিলটি পুনরায় চালু করার চেষ্টা করেও বার বার আমাদের ব্যর্থ হতে হচ্ছে। অর্থনৈতিক সংকট, কম সুদে ঋণ না পাওয়া, সরকারি প্রণোদনা ও জনবল সংকটে একাধিকবার চেষ্টা করে চালু করা যাচ্ছে না

জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, চৌমুহনীর ঘানি থেকে তৈরি সরিষা তেলের নাম-ডাক দীর্ঘদিন থেকে। বর্তমানে বাজারে সরিষা তেলের চাহিদাও অনেক বেড়েছে। আমরা ব্যবসায়ী নেতা ও ঘানি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে বন্ধ থাকা ঘানি মালিকদের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সহযোগিতা করব।