অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডের উপকূলীয় সমভূমি থেকে ৫২৭ মাইল (৮৪৮ কিলোমিটার) উত্তরে দীর্ঘ একটি প্রশস্ত পথ। পথ ধরে এগিয়ে যেতে থাকলে চোখে পড়ে ফ্যাকাসে মাটির স্তূপ। দীর্ঘ-বিস্তৃত স্মৃতিস্তম্ভের মতো এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে আছে মরুভূমির বুকে। চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বালি পিরামিডের বিক্ষিপ্ত অংশ। দূর থেকে মনে হয় দলবেঁধে দাঁড়িয়ে আছে ছোট ছোট মোবাইলের টাওয়ার।
অস্ট্রেলীয়দের ভাষায়, স্যামন-গোলাপি ধুলার এক ‘আদিম তেপান্তর’। গাছপালাহীন রহস্যময় এ ঢিবিগুলোর ভেতরেই বাস করছেন মানুষ। দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমির কেন্দ্রে অবস্থিত ওপাল খনির শহর কুবার পেডির মানুষেরা এখনো পৈতৃক রেওয়াজে পাওয়া পূর্বপুরুষের সেই গুহা বাসের রীতিকেই আঁকড়ে ধরে আছে। জানা যায়, গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপ ও হিমায়িত শীত থেকে বাঁচতেই দশকের পর দশক ধরেই ভূগর্ভ বাসের গুহা-কৌশল বেছে নেয়। কালের বিবর্তনে এখন আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে, বিলাসিতার ঢেউ লেগেছে তাদের ‘পাতালপুরি’র নগরেও।
গ্রীষ্মের দিনে কুবার পেডিতে তাপমাত্রা থাকে প্রায় ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৭৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। এত গরম যে পাখিগুলো আকাশে উড়তে গেলেই মাটিতে পড়ে যায়। তখন সঙ্গে সঙ্গে পাখিগুলোর ইলেকট্রনিক্স ফ্রিজে সংরক্ষণ করা হয়। তীব্র এ দাবদাহ থেকে বাঁচতে কুবার পেডির আদিবাসীরা আধুনিক নগর বিলাসের অন্তহীন আরাম-আয়েশের হাতছানি ছেড়ে সেই পুরোনো গুহার রীতিকেই আপন করে নিয়েছেন নিজেদের জীবন ধরনে। চলতি বছর কৌশলটি আগের চেয়ে আরও প্রাঞ্জল বলে মনে হচ্ছে। কারণ, গুহার মতো দেখতে বাড়িগুলো পাহাড় ও পুরোনো খাদে তৈরি করা হয়। তাই তাপমাত্রা সারা বছর ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে (৭৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট) মনোরম থাকে। কুবার পেডিতে প্রায় ২ হাজার ৫০০ লোক বাস করেন। মাটির নিচে গুহাগুলো অন্তত ১৩ ফুট (৪ মিটার) গভীর হয়ে থাকে। যাতে তাদের ছাদ ধসে না পড়ে।
গরমের স্বস্তি ছাড়াও ভূগর্ভস্থ জীবনযাপনের আরও কিছু সুবিধা আছে। এখানকার আদিবাসীরা নিজেরাই বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে, যার ৭০ ভাগ বায়ু ও সৌরশক্তি দ্বারা চালিত হয়। ফলে বিদ্যুতের জন্য আলাদা অর্থ খরচ করতে হয় না। অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ বাড়িগুলো তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী হয়। এছাড়াও ভূগর্ভস্থ জীবনধারা ভূমিকম্পের বিরুদ্ধে অনেকটা সুরক্ষা প্রদান করতে পারে। ১৯৬০ এবং ১৯৭০-এর দশকে কুবার পেডির বাসিন্দারা তাদের বাড়ি বানানোর জন্য গুহা খনন করা শুরু করে। বিস্ফোরক, পিক্যাক্স ও বেলচা ব্যবহার করে। যেভাবে তারা ওপাল খনি তৈরি করে। কিছু কিছু জায়গায় খুব বেশি খননের প্রয়োজন ছিল না। শুরুর দিকে পয়েন্ট হিসাবে পরিত্যক্ত খনির খাদ ব্যবহার করা হয়।
শিল্পবিপ্লবের এ যুগে গুহাগুলো শিল্প টানেলিং সরঞ্জাম দিয়ে খনন করা হয়। একটি ভালো টানেলিং মেশিন প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ২১১ ঘনফুট (৬ ঘনমিটার) শিলা ছিদ্র করতে পারে। এতে এক মাসেরও কম সময়ে একটি গুহা তৈরি করা সম্ভব। অতিরিক্ত উপকরণ ছাড়াই নিজের পছন্দ মতো যেকোনো আকারের উঁচু ছাদসহ গুহাযুক্ত কক্ষ তৈরি করা সম্ভব। প্রকৃতপক্ষে কুবার পেডিতে এখন টানেলিং এতটাই সহজ হয়েছে যে, অভিজাতদের অনেকেই ভূগর্ভস্থ সুইমিং পুল, গেম রুম, বিস্তৃত বাথরুম ও উচ্চ বিশিষ্ট লিভিং রুমসহ বিলাসবহুল বাসস্থানে বাস করতে পারছে। তবে কুবার পেডির ভূগর্ভস্থ কাঠামোর একটি বড় সমস্যা স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। গ্রীষ্মের ভারি বৃষ্টিপাতে স্যাঁতসেঁতে হয়ে ওঠে গুহার মেঝে-দেওয়াল। অনেক সময় খারাপ মাটির তৈরি পুরোনো গুহাগুলো ধসে পড়ারও ভয় থাকে। জলবায়ু চলাচলের অভাবকে এর প্রকৃত কারণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তবে কুবার পেডিই বিশ্বের প্রথম ভূগর্ভস্থ বস্তি নয়। মানুষ হাজার হাজার বছর ধরেই ভয়াবহ জলবায়ু মোকাবিলার জন্য ভূগর্ভস্থ জীবন প্রণালি অনুসরণ করে আসছেন। কুবার পেডির মতো পশ্চিম আফ্রিকার সেনেগালের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে ও মধ্য তুরস্কের ডেরিঙ্কুই অঞ্চলেও আজও গুহা রীতির প্রচলন দেখা যায়। আফ্রিকায় ১ লাখ ৭৬ হাজার বছর আগে থেকেই এ প্রচলন শুরু হয়। বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর চরম সংকট মোকাবিলা করতে বহু বছর আগে থেকেই বিভিন্ন দেশের মানুষ গুহায় বসবাস করে আসছেন।