ফ্রিডম বাংলা নিউজ

বৃহস্পতিবার, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৪ |

EN

অমানিশার ঘোর কাটিয়ে প্রজ্জ্বলিত দেশের ফুটবল

স্পোর্টস ডেস্ক | আপডেট: বুধবার, অক্টোবর ৬, ২০২১

অমানিশার ঘোর কাটিয়ে প্রজ্জ্বলিত দেশের ফুটবল

এখন আমাদের দেশের অলিতে-গলিতে, বাসার ছাদে কিংবা রাস্তাঘাটের সর্বত্রই বিশেষ একটা ফুটবল মৌসুমে ভীনদেশী ফুটবল দলের পতাকায় ছেয়ে যায়। এছাড়া রেস্টুরেন্ট, চায়ের দোকান কিংবা বন্ধুদের আড্ডায় রিয়াল বার্সা নিয়ে বা রোনাল্ডো মেসিকে নিয়ে চলতে থাকে কত মাতামাতি এবং তর্কের অঘোষিত যুদ্ধ। কিন্ত বিশ্বাস করা যায় কি এক সময়ে এগুলোর পুরোটাই দখল করে রেখেছিলো দেশের দুই প্রধান ফুটবল ক্লাব আবাহনী ও মোহামেডান!

এই দুই দলের পতাকায় ঢাকার আকাশ ঢেকে যেতো অবলীলায়। শুধু মাতামাতি কিংবা পতাকাই তুলতো না, পুরো দেশ দুইভাগে ভাগ হয়ে যেতো এই দুই ক্লাবের জন্য। দ্বৈরথ ছড়িয়ে পড়তো দেশের উত্তর থেকে দক্ষিণে। গ্যালারিতে হতো সমর্থকদের তর্জন গর্জন। গগনবিদারী চিৎকারে রোমাঞ্চ ছড়িয়ে পড়তো পুরো স্টেডিয়ামে এবং উন্মাদনা আছড়ে পড়তো প্রতিটা ঘরে ঘরে। বিকালের ম্যাচকে ঘিরে দুপুরের আগেই স্টেডিয়ামে দর্শকের আনাগোনা শুরু হয়ে যেতো। সেকি দীর্ঘ লাইন হতো স্টেডিয়ামের প্রবেশ মুখে! লোকে লোকারণ্য হয়ে থাকতো মাঠের নিকটস্থ সব পাড়া মহল্লা। সমর্থকদের উন্মাদনা এক সময় সংঘর্ষে রুপ নিয়ে নিতো। আবার কখনো কখনো সেই সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়তো পুরো শহরে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক আনার জন্য পুলিশের লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ; এগুলা ছিল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।  

কি সব শুনে রূপকথার মত মনে হচ্ছে? দেশের বিবর্ণ ফুটবলের প্রাণোচ্ছ্বাস হারানো বর্তমান ফুটবল দেখলে তা আপনার মনে হতেই পারে। তবে এটাই ছিল দেশের ফুটবলের সোনালী ইতিহাস। অথচ আজ দর্শক হারিয়ে ধুঁকছে মাঠের ফুটবল। নিজেদের দ্বৈরথ এখন শুধু কাগজ আর কলমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। খেলতে হবে বলেই যেন শুধু খেলা হচ্ছে। পায়ে ঠেলে দিয়েছে নিজেদের সেই ফুটবল ঐতিহ্য। সময়ের বিবর্তনে জৌলুস হারিয়ে ফেলেছে একসময়ের দুর্দান্ত সেই দ্বৈরথ। কিন্তু কেন হারিয়ে গিয়েছে এই দ্বৈরথ? বর্তমান সময়ের বিভিন্ন পরিসংখ্যানও বলছে মাঠের দর্শক হারিয়ে যায়নি। 

উত্তরটি খুব সোজা। যে ক্লাবের দর্শকরা একটা সময়ে এতবেশি উত্তেজিত হয়ে থাকতো, সেই দর্শকদের পরবর্তী প্রজন্মকে সমর্থনে ভেড়ানোর জন্য কোন পরিকল্পনাই নেওয়া হয়নি। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ক্লাব দুটি নিজেদের বিপণন ব্যবস্থাও করেনি। অথচ আমরা ইউরোপ ফুটবলের দিকে তাকালেই দেখতে পাই তারা তাদের দর্শকদের একটা বিশাল অংশ বিপণন ব্যবস্থার মাধ্যমেই আকৃষ্ট করে রেখেছে। এছাড়াও নতুন প্রজন্ম কেন দেশের ফুটবলের প্রতি আজ আকৃষ্ট নয়, তা নিয়েও কখনো গবেষণা করেনি তারা। নিজেদের অতীত নিয়েও কোন প্রচারণা চালায়নি এই দুটি দল। অথচ এগুলো নিয়েই তাদের আত্মোপলব্ধি করা একান্ত প্রয়োজন ছিল।

এছাড়া দেশের ফুটবলকে তলানিতে নিয়ে আসার জন্য বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনও অনেকাংশে দায়ী। সীমাহীন দুর্নীতি, অনিয়ম আর অপেশাদারি মনোভাবের কাছেই দেশের ফুটবল যেন হেরে গিয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনও বাফুফেকে কয়েক দফা চিঠি দিয়েছিলো। এছাড়া এই আধুনিক যুগে এসেও দেশের ফুটবলারদের শারীরিক ফিটনেস ধরে রাখার জন্য একটি নিজস্ব জিমনেসিয়াম পর্যন্ত নেই, এটা কল্পনা করা যায়? পাইপলাইনে খেলোয়াড় তৈরি করার সেরকম কোন ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। নতুন তেমন কোন ফুটবল তারকার দেখাও মিলেনি এজন্য। এছাড়া নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ ফুটবল লীগে যখন গণজোয়ার বইছিলো তখন হুট করেই ক্লাব দলে বিদেশী কোটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তখন থেকে দর্শক কমা শুরু হয়েছিল, এবং সেই সময় থেকেই মূলত দর্শকরা আস্তে-ধীরে মাঠ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো। এছাড়া সময়ের পরিক্রমায় এখন আবাহনী ও মোহামেডান সেরা দল হিসেবে নিজেদেরকে আর ধরে রাখতে পারেনি। নতুন দলগুলো শ্রেষ্ঠত্বের জায়গা দখল করে নিলেও এই প্রজন্ম তাদের দিকে মনোযোগী নয়। স্বাভাবিক ভাবেই তারা মুখ ঘুড়িয়ে রেখেছে ইউরোপের ফুটবলের দিকে।

১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা মোহামেডানের ঢাকাস্থ শাখা ঢাকা মোহামেডান ক্লাবের সাথে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর জৈষ্ঠ্যপুত্র শেখ কামাল আবাহনী ফুটবল ক্লাব প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে দেশের ফুটবলে যে বিপ্লব শুরু করেছিলেন, সেই ফুটবল বিপ্লবকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়ে কর্তারা মুখে শুধু সন্তুষ্টি জড়িয়েছিলেন। মাঠ দর্শক শূন্য থাকলেও এরা থাকেন পুরোপুরি উদাসীন! এসব হর্তাকর্তারা ক্লাবের ভেতরে ক্যাসিনোর রমরমা ব্যবসা শুরু করে দিয়েছিলেন। যে মতিঝিল পাড়াতে একটা সময়ে ফুটবলপ্রেমীদের উপস্থিতিতে লোকারণ্য হয়ে থাকতো, সেই ক্লাবগুলোতে প্রতিদিন শুরু হতো ক্যাসিনো বা জুয়ার আসর। তারা যে ফুটবলের নব জাগরণ নিয়ে কোন প্রকার চিন্তা রাখেননি তা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়।

মালদ্বীপের রাজধানী মালেতে এবার বসেছে সাফ চ্যাম্পিয়ানশিপের ১৩তম আসর। টুর্নামেন্টের প্রথম দিনে শ্রীলংকার বিপক্ষে ১-০ তে জয়ের সুখস্মৃতি নিয়ে শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে মাঠে নামে বাংলাদেশ। টুর্নামেন্টে সবচেয়ে ফেবারিট ভারতের মোকাবেলায় জামাল ভূঁইয়াদের চেষ্টা বিফল যায়নি। খেলার ২৬ মিনিটে সুনীল ছেত্রীর গোলে পিছিয়ে পড়ে ফিফার ১৮৯তম র‍্যাংকিংয়ে থাকা দল বাংলাদেশ। দ্বিতীয়ার্ধের মাত্র ৭ মিনিটেই লালকার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন বিশ্বনাথ ঘোষ। পরের লড়াই বাংলাদেশের জন্য এক গৌরবগাঁথা। ১ জন কম নিয়েও জামাল ভূঁইয়ার কর্নারে ইয়াছিনের  গোলে সমতায় ফেরে অস্কার ব্রুজোনের শিষ্যরা।

দেশের ফুটবল আকাশে অমানিশার ঘোর কাটিয়ে আবাহনী মোহামেডানের দ্বৈরথ তথা জাতীয় ফুটবলে ভোরের সূর্য লালের উদয় হোক। উদয় হোক নতুন কোন জাদুকরের, যার পায়ের জাদুতে এই প্রজন্ম রোনাল্ডো মেসিকে পাশ কাটিয়ে মুগ্ধ হবে। কোলাহলে পূর্ণ হোক বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম, নতুন আলোয় ফ্লাডলাইট জ্বেলে দিয়ে!