৬০ বছর বয়সী আমজাদ হোসেনের জাতীয় পরিচয় পত্রে মায়ের নাম মৃত আমেনা খাতুন। তার বাকি ৪ চার ভাইবোনের জাতীয় পরিচয় পত্রেও উল্লেখ আছে তাদের মা মৃত। ২২ বছর আগে আমেনা খাতুন নিখোঁজ হয়েছিলেন বগুড়া থেকে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান না মেলায় সন্তানরা ধরে নিয়েছেন তাদের মা মারা গেছেন। ২২ বছর পর সেই আমেনা খাতুন সন্তান, নাতি-নাতনিদের কাছে ফিরলেন নেপাল থেকে। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মায়ের সামনে বাকরুদ্ধ তার সন্তানরা।
সোমবার দুপুরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকায় আসেন আমেনা খাতুন। তার খোঁজ পাওয়া, দেশে ফেরা পুরোটাই যেন সিনেমার গল্প
আমেনা খাতুনকে সঙ্গে নিয়ে দেশে ফিরেছেন নেপালে বাংলাদেশ দূতাবাসের কনস্যুলার মাসুদ আলম। তিনি
বলেন,
‘তিন
মাস
আগে
আমাদের
কাছে
খবর
এলো—
নেপালের
সুনসারি
জেলায়
এক
বাংলাদেশি
নারীকে
পাওয়া
গেছে,
সেখানে
তিনি
মানবেতর
জীবন-যাপন
করছেন। সেখানকার মিউনিসিপ্যাল থেকে আমাদের কাছে অনুরোধ জানানো হলো, আমরা যেন তাকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করি। করোনার
কারণে
তখন
যাতায়াত
সম্ভব
ছিল
না। তারপরও আমরা কাঠমাণ্ডু থেকে প্রায় ৪৫০ কিলোমিটার দূরে সুনসারি জেলায় যাই। আমেনা
খাতুনের
সঙ্গে
কথা
বলি। জানতে পারি, তার গ্রামের বাড়ি বগুড়ায়। তখন
দূতাবাসের
উদ্যোগে
তাকে
উদ্ধার
করে
দেশে
ফেরানোর
চেষ্টা
শুরু
হয়।’
জানা গেছে, আমেনা খাতুন সুনসারি জেলায় মানুষের বাসাবাড়িতে কাজ করতেন। কিন্তু
বয়স
বাড়ায়
কর্মক্ষমতা
ফেলেন। ফলে রোজগার না থাকায় ফুটপাতেই থাকতেন তিনি। সেখানে
থাকা
বাংলাদেশি
নাগরিকরা
প্রথমে
তার
সন্ধান
পান। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমেনার বিষয়ে পোস্ট দেন। সেখানকার
মিউনিসিপ্যাল
কর্তৃপক্ষ
তাকে
উদ্ধার
করে
দূতাবাসকে
জানায়। এরপর দূতাবাসের কনস্যুলার মাসুদ আলম বাংলাদেশে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) সংস্থার মাধ্যমে বগুড়ায় আমেনার পরিবারের সন্ধান করেন।
আমেনা খাতুনের নাতি মো. ফাহিম বলেন, ‘আওয়ামী লীগের স্থানীয় এক নেতা আমাদেরকে এনএসআইই’র জেলা অফিসে যেতে বলেন। সেখানে আমাদেরকে দাদির ছবি দেখিয়ে জানতে চান, আমরা তাকে চিনি কিনা। আমার বাবা-চাচারা ছবি দেখে দাদিকে চিনতে পারেন।
নেপালে বাংলাদেশ দূতাবাসের কনস্যুলার মাসুদ আলম বলেন, ‘পরিবারের লোকেরা আমেনাকে শনাক্ত করার পর আমরা তাকে দেশে ফেরানোর উদ্যোগ নেই। লকডাউনে ফ্লাইট বন্ধ থাকায় এত দিন তাকে দেশে আনা যায়নি। এছাড়া তার পাসপোর্ট না থাকায় কিছু আইনি জটিলতাও ছিল। শেষ পর্যন্ত নেপালের কেবিনেট থেকে সহায়তা নিয়ে আইনগত আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়।’
সোমবার সকালে নেপালে বিমানবন্দরে নিয়ে আসা হয় আমেনা খাতুনকে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কর্মীরা তাকে ফ্লাইটের আনুষ্ঠানিকতায় সহায়তা করেন। তাকে ফুল দিয়ে বিদায় জানান বিমানের কর্মীরা।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছার পর মা আমেনার সামনে প্রথমে হাজির হলেন বড় ছেলে আমজাদ হোসেন। বাকরুদ্ধ হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এরপর ৫৮ বছর বয়সী মেজো ছেলে ফটিক হোসেন, ৫৪ বছর বয়সী ছোট ছেলে ফরাজুল ইসলাম, ৪৫ বছর বয়সী মেয়ে আম্বিয়া খাতুন মায়ের সামনে এসে দাঁড়ান। বড় ছেলের নাম বলতে পারলেও বয়োবৃদ্ধ আমেনা তাকে চিনতে পারেননি প্রথম দেখায়। তবে বাকিদের চিনলেন ঠিকঠাক।
আমজাদ হোসেন বলেন, ‘আমার নিজেরই বয়স হয়েছে। মাকে যে আর ফিরে পাবো তা কখনও আশা করিনি। তিনি আজ ফিরলেন। আমি বোঝাতে পারবো না, আমার ভেতরটায় কী হচ্ছে।’
কীভাবে নিখোঁজ হলেন তাদের মা, জবাবে আমেনার দ্বিতীয় সন্তান ফটিক হোসেন বলেন, ‘২২ বছর আগে বাড়ি থেকেই মা নিখোঁজ হন। তখন তার মানসিক সমস্যা ছিল। যেখানে খবর পেয়েছি, ছুটে গিয়েছি মায়ের খোঁজে। কিন্তু এত বছরে সন্ধান না পেয়ে আমরা ধারণা করেছিলাম, তিনি হয়তো মারা গেছেন।’
বগুড়ার ধুনট উপজেলার মাজবাড়ি গ্রামের আজগর আলী প্রামাণিকের স্ত্রী আমিনা খাতুন। নিখোঁজ হওয়ার বছর তিনেক আগে তার স্বামী মারা যান।
নাটকীয়ভাবে দেশে ফিরলেও তার নেপালের যাওয়ার রহস্য উন্মোচন হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশে নিখোঁজ আমেনা খাতুন হয়তো মানব পাচারকারীদের কবলে পড়েছিলেন।
নেপালে বাংলাদেশ দূতাবাসের কনস্যুলার মো. মাসুদ আলম বলেন, ‘তিনি (আমেনা) আসলে কোনোভাবেই মনে করে বলতে পারছেন না যে, কীভাবে নেপালে গেছেন, কবে গেছেন। ফলে এই বিষয়টি পরিষ্কার না। তবে এক সময় যেহেতু মানবপাচারের আধিক্য ছিল, তেমন কিছুর শিকারও হতে পারেন।’
৭০ ঊর্ধ্ব আমেনা খাতুন এখন আর পরিষ্কারভাবে কিছু বলতেও পারেন না। নিজের নাম বলতে পারলেও তার কথা অনেকটাই অস্পষ্ট।
আমেনা খাতুনকে দেশে আনতে বিমানভাড়াসহ যাবতীয় খরচ বহন করেছে সরকার, জানালেন নেপালে বাংলাদেশ দূতাবাসের কনস্যুলার মো. মাসুদ আলম।