ফ্রিডম বাংলা নিউজ

শুক্রবার, অক্টোবর ১৮, ২০২৪ |

EN

পাকিস্তান কি ভারতকে চালকের আসন থেকে ছিটকে দিচ্ছে?

ফ্রিডমবাংলানিউজ ডেস্ক | আপডেট: বৃহস্পতিবার, সেপ্টেম্বর ২, ২০২১

পাকিস্তান কি ভারতকে চালকের আসন থেকে ছিটকে দিচ্ছে?

একটা সময় ছিল যখন খেলার মাঠ এবং রাজনীতির মাঠ, দুই মাঠেই ভারতের ছিল দোর্দণ্ড প্রতাপ। শুধু এশিয়াই নয়, বিশ্ব রাজনীতির ময়দানে তাদের চলাফেরা ছিল একদম চিতাবাঘের মতো সতর্ক এবং ক্ষিপ্র। ঠিক একই ভারতের চিত্রই যেন গত কয়েকদিনে আমরা দেখতে পাচ্ছি একদম ভিজে বেড়ালের মতো হয়ে গেলো। খেলার মাঠে ইংল্যান্ডের কাছে ভারতের অসহায় আত্মসমর্পণ তো বটেই, রাজনীতির মাঠেও ভারত যেন একদম পিছিয়ে যাচ্ছে। অন্তর্কোন্দল তো আছেই, একইসাথে বৈশ্বিক রাজনীতিতেও ভারত অনেক ব্যাকফুটে।

 

গত ১৫ আগস্ট বিশ্বের রাজনীতির ইতিহাসে ঘটে গেলো অভূতপূর্ব এক ঘটনা। আফগানিস্তানের ভূমি থেকে মার্কিন সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়ার পর থেকেই একের পর এক প্রদেশ দখল করে পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়েছে তালেবানরা। কিছুদিনের মধ্যেই তারা নিজেদের সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। আফগানিস্তানের এই জয়ে উপমহাদেশের দুটি দেশ বিশালভাবে লাভবান হতে যাচ্ছে। হুট করেই দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয়েছে পাকিস্তান। তারচেয়ে বরং এখন বলা যেতে পারে, বৈশ্বিক রাজনীতিতে উপমহাদেশের চালকের আসনে ভারতকে হটিয়ে দিয়ে পাকিস্তান চাকাটা নিজেদের হাতে নিয়ে নিতে পারে। তবে সে আলোচনায় যাবার আগে কিছু দিক দেখে নেয়া প্রয়োজন।

 

প্রথমেই আমাদের দেখতে হবে যে পাকিস্তান সরকার এবং সেনাবাহিনী দুজনে স্বার্থরক্ষায় নিজেদের ফায়দাটা আগে দেখে। তাদের মধ্যে বলা যায় একধরণের প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব রয়েছে। তবে আফগানিস্তানে তালেবানের বিজয়ে পাকিস্তান সরকার এবং সেনাবাহিনী- দুইদলই আনন্দে তাদের বগল বাজাতে শুরু করেছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তো আনন্দের আতিশয্যে বলেই ফেললেন যে তালেবানের এই জয় দাসত্বের নিগঢ় থেকে বন্দী হবার জয়।

 

ইমরান খানের এই সমর্থনের পেছনে কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, আইডিওলজিকাল দিক থেকে তালেবানের সাথে পাকিস্তানের আদর্শগত মিল রয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি দেশের বিভক্তি হয়েছিল মূলত ধর্মের দিক থেকেই। আর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের পর পাকিস্তান আরও সটকে পড়ে। এই হারের কারণে পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের বেলুচিস্তান এবং খাইবার-পাখতুনওয়ার অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান সরকার অনেক ঝামেলার মাঝে পড়ে যায়। এসব অঞ্চলগুলোর বেশিরভাগই ছিল পশতুন অধ্যুষিত জনগোষ্ঠী। পশতুন জাতীয়তাবাদকে দমিয়ে রাখার জন্যই পাকিস্তান এসব অঞ্চলের সীমান্তের কাছে মাদ্রাসা স্থাপন করে, যাতে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের কাছে পশতুন জাতীয়তাবাদ মার খেয়ে যায়। তালেবান নেতাসহ তাদের বেশিরভাগ সমর্থকেরা এসব মাদ্রাসাগুলোতেই শিক্ষালাভ করেছিল।

 

দ্বিতীয়ত, আফগানিস্তানের সীমানা নিয়ে পাকিস্তান কর্মকর্তাদের চিন্তা ছিল যে যদি তালেবানেরা ক্ষমতায় আসে, তাহলে তা নিয়ে তাদের চিন্তা অনেকাংশেই কমে যাবে। ১৯৪৭ সাল থেকেই আফগান সরকার পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যকার ডুরান্ড লাইনের সমর্থন নাকচ করে আসছে। পশতুন এলাকার জনগণ এই ডুরান্ড লাইনের কাছে নিজেদের অঞ্চলকে নিজেদের অঞ্চল হিসেবে মনে করে এবং তারা ভাবে এসব অঞ্চলকে পশতুনিস্তান হিসেবে দাবি করা যায়। আর পাকিস্তান সরকারও মনে করছে তালেবানের যেসব ধর্মীয় চিন্তাভাবনা আছে, তা পশতুনদের জাতীয়তাবাদকে দাবিয়ে রাখতে পারবে।

 

তৃতীয়ত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে, আফগানিস্তানে এমন একটি সরকারের প্রয়োজন ছিল যা পাকিস্তানের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করবে এবং পাকিস্তানবান্ধব হবে। পাকিস্তান ভারতের প্রতি সবসময়েই এই অভিযোগ আনছে যে ভারত দেশটিকে ধর্মের ও ভাষাগত দিক থেকে সবসময় পিছিয়ে রাখছে বিশ্বরাজনীতি থেকে। আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির সাথে ভারতের সুসম্পর্ক থাকার কারণে পাকিস্তানের কপালের ভাঁজ আরও দীর্ঘায়িত হতে শুরু করে। তালেবান সরকার ক্ষমতায় আসবার পর পাকিস্তান সরকার এবার হাঁপ ছেড়ে বাঁচতেই পারে এবং ভারতের বিরুদ্ধে যেসব জিহাদী দল রয়েছে, তাদের জন্য আফগানিস্তানের মাটি ভূস্বর্গ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।

 

তালেবানকে অস্ত্র সহায়তা ও আর্থিক সহায়তা দেয়ার অভিযোগ পাকিস্তানের ওপর শুরু থেকেই আছে এবং অনেকে এটাও বলে থাকেন যে আজকের তালেবানরা যে ক্ষমতায় এসেছে, এই ক্ষমতায় আনবার পেছনে পাকিস্তানেরই সবচেয়ে বড় হাত আছে। পাকিস্তানের আইএসআই তালেবানদের এমনকি সমরের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণও দিয়েছে। তালেবানের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করা হাক্কানি গ্রুপের সাথে আইএসআইর খুবই হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক, সেটি সকলেই জানে। এছাড়াও পাকিস্তানে তালেবানদের অনেক রিয়েল এস্টেট এজেন্সি রয়েছে এবং ব্যক্তিগত পরিচালনায়ও অনেক সম্পত্তি রয়েছে।

 

তবে পাকিস্তানের কিন্তু একটি ভয়ও আছে। তালেবানের সাথে তাদের যে সুসম্পর্ক ছিল, সেটি ধীরে ধীরে কমতে পারে। বর্তমানে যে তালেবানরা ক্ষমতায় এসেছে, তারা আগের চেয়ে বেশি সুসংহত এবং পরিণত। শুরুতেই রাশিয়া, চীন এবং তুরস্কের সাথে তারা সম্পর্ক ভালো করে ফেলেছে। আর বিশ্বের রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে চীন। দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ ভুটান ছাড়া অপরাপর অন্যান্য দেশগুলোর ওপর তারা নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। টিকাপ্রদান দেয়া থেকে শুরু করে আর্থিক সাহায্য, ইনফ্র্যাস্টাকচার তৈরি ইত্যাদি নানা কাজে হাত দিয়েছে চীন। শ্রীলঙ্কায় বন্দর থেকে শুরু করে জনপথ বিনির্মাণ ইত্যাদি বিষয়ে তারা নিজেদের কাজ দেখাতে শুরু করেছে। এছাড়াও ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মিলিত কোয়াড নির্মাণেও তারা অপরাপর দেশগুলোকে দিয়েছে চোখরাঙ্গানি, যেখানে বাংলাদেশও আছে। এছাড়াও চীনের জিনজিয়ান প্রদেশে রয়েছে উইঘুর মুসলিমদের নিয়ে ক্রমবর্ধমান চিন্তার উন্মেষ। পাকিস্তান এবং তালেবান স্বার্থ যদি মিলে যায়, তাহলে উইঘুরদের নিয়ে কী করা যায়, সেটি নিয়েও চীনের মাঝে চিন্তার অনেক অবকাশ চলে আসে।

 

পাকিস্তান বর্তমানে একটি মারাত্মক ঝুকিপূর্ণ খেলায় মত্ত আছে। তালেবানরা শেষ পর্যন্ত তাদের পাশে থাকবে কিনা, সেটি সময়ই বলে দেবে। আর তালেবানরা চাইবে শক্তিশালী বন্ধুদের কাছে রাখতে, যেটি চীন-রাশিয়া-তুরস্কের ক্ষেত্রে খাটে। ডুরান্ড লাইনকে কাজে লাগানোর জন্য পাকিস্তানও অনেক অর্থ ব্যয় করেছে। আফগান সরকার সেটিকে নাকচ করে দিয়েছে। এবার তালেবানগঠিত সরকারের দিকে পাকিস্তানিদের আশায় মুখ চেয়ে থাকতে হবে। আর তারচেয়েও তাদের জন্য একটি আশার সংবাদ হচ্ছে, তালেবানরা তাদের আগ্রহ দেখিয়েছে জম্মু-কাশ্মির ইস্যুতে, যা ভারতের জন্য মাথাব্যথার বিষয়। এক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় তালেবানদের কোনো সাহায্য তারা পাবে না। পাল্লাটা পাকিস্তানের দিকেই ভারি হবে বেশি। ওয়াশিংটন এদিকে চাইছে নয়াদিল্লীর সাথে তাদের সম্পর্ক ভালো রাখতে। আর বেইজিং ঝুঁকে যাচ্ছে পাকিস্তানের দিকে। ফলে খেলাটা সমতার কথা থাকলেও ঝুলে যাচ্ছে অসমতার দিকে। কারণ আরও দুজন শক্ত প্রতিপক্ষ হচ্ছে রাশিয়া এবং তুরস্ক। আর ইউরোপিয়ান দেশগুলোর দিকে মুখ চেয়ে লাভ নেই, কারণ তারা নিজেরাই এখন খোদ বুঝতে পারছে না তালেবানদের কীভাবে সামাল দেবে বর্তমান ইস্যুতে।

 

তাই, তালেবানরা ভবিষ্যতে তাদের আগ্রহ কোনদিকে নেবে তা বলা মুশকিল, তবে বর্তমানে তারা পাকিস্তানের দিকেই যে নিজেদের ভারকে সুসংহত করবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই বলা যেতে পারে, উপমহাদেশের চালকের আসন থেকে খুব দ্রুতই ভারতকে ছিটকে দিতে যাচ্ছে পাকিস্তান।

সৌজন্যে: বাংলাইনসাইডার