ফ্রিডম বাংলা নিউজ

বৃহস্পতিবার, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৪ |

EN

ফুলবাড়ীতে শতবছরের ঐতিহবাহী চৈত্র সংক্রান্তি মেলা

মেহেদী হাসান, ফুলবাড়ী, দিনাজপুর | আপডেট: শুক্রবার, এপ্রিল ১৫, ২০২২

ফুলবাড়ীতে শতবছরের ঐতিহবাহী চৈত্র সংক্রান্তি মেলা
গ্রামবাংলা ঋতুভিত্তিক নানা উৎসব ও পার্বণ সংস্কৃতি চর্চার মেলবন্ধন। তেমনি গ্রামীণ মেলা, চৈত্র সংক্রান্তি কিংবা বৈশাখী মেলা বাঙালি সংস্কৃতির গুরুত্বপ‚র্ণ একটি অংশ। করোনার কারনে দু বছর মানুষ সবকিছু থেকে দুরে থাকলেও আবার তা স্বাভাবীক হতে শুরু করেছে।
প্রচলিত একটি কথা আছে 'বাঙালির বারো মাসে তোরো পার্বণ'। এরই ধারাবাহিকতায় দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার গ্রামে প্রতি বছর চৈত্রের শেষ দিনে চৈত্র সংক্রান্তি মেলা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এবছর চৈত্র সংক্রান্তির এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে ১লা বৈশাখের দিনে। 
বৃহস্পতিবার উপজেলার খয়েরবাড়ী কিসমতলালপুর এলাকার মহদিপুর শিব মন্দির মাঠে দিন ব্যাপী শত বছরের প্রাচীণ ঐতিহবাহী চৈত্র সংক্রান্তি এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। 

মেলার সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্টীর কৃষ্টিকালচার ও সংস্কৃতির যোগাযোগ ছিল নিবিড়। এই সংস্কৃতিতে ঘটে সব ধর্মের মানুষের সংস্কৃতির সমন্বয়। বেশ কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকার কেন্দ্রস্থল মিন্দর মাঠে বট গাছের নিচে খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় মেলার। 
মেলাকে ঘিরে যেন গ্রামীণ জীবনে ফিরে আসে প্রাণচাঞ্চল। গ্রামীণ এ মেলা কে কেন্দ্র করে সেখানে নানা রকমের মিষ্টি,জিলেপি ও গ্রামীন খাবর থেকে শুরু করে বিভিন্ন জিনিস পত্রের দোকানের পরশা বসে। মৃৎশিল্প ও কারুপণ্যের বিকিকিনি মেলার আরেক আকর্ষণ। এসব মৃৎশিল্পের মধ্যে শখের হাঁড়ী, বিভিন্ন ধরনের মাটির পুতুল বেশ জনপ্রিয়, এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মন্ডা মিঠাই।

স্থানীয় সাবেক ইউপি সদস্য ও সমাজ সেবক মহেন্দ্রনাথ সরকার সহ এলাকার প্রবীণ ব্যাক্তিরা জানান,বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি নিয়ে দৈনন্দিন জীবনে সাংস্কৃতিক চর্চায় এক সময় বেশ মনোযোগ ছিলো মানুষের। বাঙালির সকল কাজের সাথে মাটির ঘ্রাণ ও শেকড়ের নিবিড় টান ছিলো বিদ্যমান। কালের বিবর্তনে মেলার সেই আগের জৌলস নেই,তবে বিলুপ্ত হয়ে যাইনি এখোনো।

মেলার গোড়াপত্তন করতেন তৎকালীন সময়ের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। বর্তমানে তাদের উত্তর সুরিরা বংশগত পরম্পরায় প্রতি বছর সেই মেলার আয়োজন করে আসছেন। এদিকে মেলাকে কেন্দ্র করে আশে পাশের গ্রামে বিরাজ করে এক উৎসবের আমেজ। বাড়িতে বাড়িতে আতœীয় স্বজনের হিড়িক পড়ে। ছোটদের সাথে বড়োরাও মেতে উঠেছেন গ্রামীণ মেলার আবহে। সেইসাথে এই মেলা নতুন জামাইদের জন্য বেশ প্রতিযোগিতার, কারণ কোন জামাই কত সদাই নিয়ে যাবে শশুর বাড়িতে।

কথা হয় বিরামপুর থেকে শশুর বাড়ীতে মেলা দেখতে আসা ওয়াকিল সরকার নামে এক জামাইয়ের সাথে,তিনি জানান বিয়ে হওয়া প্রায় পনের বছর হলো প্রতি বছর এই দিনে পরিবারের সবাই মিলে শশুর বাড়ীতে মেলা দেখতে আসি। মেলা ঘুরে বিভিন্ন রকমের মন্ডা মিঠাই সহ সদাই কিনে নিয়ে যাই শশুর বাড়ীতে,এতে বেশ ভালো লাগে। এবছরেও এসেছি,তবে আগের তুলনায় বর্তমানে মেলা ততটা জাকজমক নয়। 

মন্দির এবং মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য কমল সরকার ও বিশে^সর সরকার জানান, এটি একটি শতবছরের পুরোনো মেলা। আমাদের পুর্ব পুরুষের সময় থেকে এই মেলা হয়ে আসছে,এরই ধারাবাহিকতায় আমারাও প্রতিবছর মেলার আয়োজন করে আসছি,এরপরে আমাদের ছেলেরাও করবে। 
আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি মেলাকে কেন্দ্র করে স্বজনের বেশ উপস্থিতি থাকে। যার ফলে মেলাটা রুপান্তরিত হয় পারিবারিক অনুষ্ঠানে। তবে আগের সেই আয়োজন না থাকলেও মেলা নিয়ে আগ্রহের কোন কমতি নেই। আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি তরুণ প্রজন্মের মাঝে পৌঁছে দিতে বাড়ির ছোটদের মেলায় নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ের সাথে পরিচয় করে দেই। যাতে করে অস্তিত্ব ও শেকড় থেকে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম দূরে সরে না যায়। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বিলুপ্তের হাত থেকে রক্ষা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব।

শহর থেকে প্রাচীনতম এই মেলায় বেড়াতে আসা নারায়ন শর্মার কাছে গ্রামীণ মেলা সম্পর্কে জানতে চাইলে, তিনি বলেন, মেলা বাঙালির প্রাণের উৎসব। একটা সময় ছোট বেলায় মাটির ব্যাংকে আমরা টাকা জমিয়ে রাখতাম,মেলায় খেলনা কেনার জন্য।

খয়েরবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. এনামুল হক মেলা পরিদর্শনে এসে বলেন, গ্রামীণ মেলা, চৈত্র সংক্রান্তি কিংবা বৈশাখী মেলা বাঙালির সংস্কৃতির গুরুত্বপ‚র্ণ একটি অংশ।চৈত্রসংক্রান্তি মেলা হোক বা বৈশাখী মেলা এই সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো ছিলো সকল ধর্মাবলম্বী মানুষের মাঝে অসম্প্রদায়িক সেতুবন্ধন। গ্রামীণ মেলা যেমন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে উৎসব তেমনি মুসলমান পরিবারের স্বজনের উপস্থিতি এবং নানা পারিবারিক আয়োজন মেলায় ভিন্ন মাত্রা যোগ করতো। পরিতাপের বিষয় সময়ের সাথে সাথে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আজ বিলুপ্তের পথে। তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশ আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতি থেকে অনেকটা বিচ্যুত। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে সংস্কৃতি,কৃষ্টি সম্পর্কে অবগত করতে হবে পাশাপাশি গ্রামীণ মেলা,সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানাদি ব্যাপক পরিসরে আয়োজন করতে হবে।