ফ্রিডম বাংলা নিউজ

বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪ |

EN

মুক্তি-দ্বিতীয় পর্ব

ফ্রিডমবাংলানিউজ ডেস্ক | আপডেট: রবিবার, ফেব্রুয়ারী ২০, ২০২২

মুক্তি-দ্বিতীয় পর্ব
বাবার চাকুরী সূত্রে কাবেরীদের পরিবার  কুমিল্লা শহরে। মমতাজ বেগম কুমিল্লা মহিলা কলেজের ভিপি। মমতাজ আপা সম্পর্কে নানা গল্প শুনেছে কাবেরী। সে বিপ্লবী নেত্রী। ঢাকার ইডেন কলেজের ছাত্রী ছিলেন। হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার কারনে সরকার তাকে ইডেন কলেজ থেকে বহিস্কার করে দিয়েছে,পরীক্ষা দিতে দেয়নি। একজন নারীর এত সাহসের কথা শুনে নিজের অজান্তেই মমতাজ বেগমের ভক্ত হয়ে উঠলো কাবেরী। মনে  খুব ইচ্ছে হলো মমতাজ আপার সঙ্গে সে পরিচিত হবে। কি ভাবে মমতাজ আপার সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়? এত বড় সাহসী কতই না দুর্ধর্ষ তিনি,যদি আবার বকা দেয়,অপমান করে, নানা কথা  ভাবে সে। মহল্লার একটি মেয়ের সঙ্গে বেশ ভাব হয়েছে কাবেরীর। ওরা এক সঙ্গে কলেজে আসা-যাওয়া করে। সাথী নামের ওই মেয়েটি কাবেরীর চেয়ে এক ক্লাস ওপরে পড়ে। তবুও খুব ভাব তাদের বন্ধুর মত আচরণ । সাথীর এক ফুফাতো ভাই আফজাল খান তখোন কুমিল্লা শহরে নামকরা ছাত্রনেতা। শেখ মুজিবের দল করে। সাথীর বাবাও মুসলিম লীগ ছেড়ে শেখ সাবের ভক্ত হয়ে উঠেছেন। আফজাল খানকে মাঝে মাঝে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। সাথীর বাবা উকিল,তিনি কোট থেকে আফজাল খানকে ছাড়িয়ে আনেন। মাঝে মাঝে মমতাজ আপাকে নিয়ে সাথীও জেল গেটে গিয়ে আফজাল খানকে ফুলের মালা দেয়। সাথী সে সব গল্প শোনায় কাবেরীকে । মমতাজ আপার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছের কথা একদিন সাথীকে জানায় কাবেরী। এর মধ্যে কলেজে নির্বাচন হবে বলে গুঞ্জন শোনা গেল। কাবেরী বেশ উৎফুল্য। সে কলেজে ভোট দিতে পারবে। কি আনন্দ! বেশ মজা হবে। বাড়িতে খাবার টেবিলে-মা-বাবাকে বললো,  আমাদের কলেজে ভোট হবে। আমরা ভোট দেবো। এক অন্যরকম আবেগ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে কাবেরীকে সে ভোট দিতে পারবে। কাবেরীর মা বলে উঠলো, ভোট হবে ভালো আবার নিজে নির্বাচনে দাড়িঁয়ে যেও না। কাবেরীর বাবা হাসে, স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে দাড়াঁলে দোষ কি? তোমার মেয়ে নেত্রী হবে? কর্কশ কণ্ঠে কাবেরীর মা জবাব দেয়, শোনো মেয়েকে কিন্ত তুমি খুব অস্কারা দিচ্ছো? এ নিয়ে বেশ কিছুক্ষন হাসি-ঠাট্টা চলে। কাবেরী পড়ার টেবিলে যায়। স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে কাবেরীর বাবা বলে শোন, আমার মেয়ে অবিবেচক মেয়ে নয়। নিজের বুদ্ধিতে ও যা করার করবে। মেয়ের প্রতি আমার ভরসা আছে। আড়াল থেকে সব শুনে কাবেরী।

সে দিন রোববার কলেজ বন্ধ। কাবেরী ও সাথীদের বাসা পাশাপাশি। দুপুরের পর কাবেরী যায় সাথীদের বাসায়। সাথী জানায় তুমি এসে ভালো করেছো। আজ মমতাজ আপা আসবেন আমাদের বাসায়। কলেজে নির্বাচন, মমতাজ আপা ভিপি পদে নির্বাচন করবেন। আমাকেও নাকি কোন এক পদে দাড়াঁতে হবে। আফজাল ভাই বলে দিয়েছেন। মমতাজ আপা আসবেন বাবার সঙ্গে কথা বলে অনুমতি নেওয়ার জন্য। মমতাজ আপার সঙ্গে আসবেন ছাত্রলীগের আরেকজন নেতা সৈয়দ রেজাউর রহমান। কিছুক্ষন পরেই তারা এসে পড়লেন। সাথী মমতাজ আপা ও সৈয়দ রেজাউর রহমানের সঙ্গে কাবেরীর পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন, ওর নাম কাবেরী,আমাদের কলেজের ছাত্রী। ওর বাবা পুলিশ আফিসার। আনুষ্ঠানিক পরিচয় হলো মমতাজ আপার সঙ্গে। এরপর কলেজে গেলেই কথা হতো। মমতাজ আপা খুজেঁ বের করতেন কাবেরীকে। এক সময়ে দু'জন বেশ ঘনিষ্ট হয়ে উঠলো। কাবেরী ছাত্রলীগের রাজনীতি করে না,মিছিলে যায় না তবে দারুনভাবে রাজনৈতিক সচেতন। দেশের খোজঁ খবর রাখে। হোক নারী বা পুরুষ পৃথিবীতে কিছু মানুষের জন্য হয় যাদের দেখলে আপন আপন মনে হয়। নিজের স্বজন মনে হয় তেমনি একজন কাবেরী মিত্র। আবার কিছু লোককে সৃষ্টিকর্তা পাঠিয়েছেন খুবই দুর্ভেদ্য চরিত্র দিয়ে যাকে কখনোই আপন ভাব যায় না।

কাবেরীর খুব জানতে ইচ্ছে করে কি ভাবে মমতাজ আপা  এত বড় নেত্রী হয়ে উঠলেন। কেনই বা রাজনীতি করতে আসলেন। তাও আবার আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে। শেখ মুজিবের রাজনীতি, এত কঠিন বিষয়। পুলিশ কর্মকর্তার মেয়ে হওয়ার কারনে মাঝে মাঝে বাবার কাছ থেকে কাবেরী জানতে পারে-আইয়ুব খানের সরকার শেখ মুজিবের ওপর কি পরিমান ক্ষ্যাপা। একবার কাবেরীর বাবার ওপর নির্দেশ এসেছিলো শেখ মুজিব কুমিল্লা মিটিং করতে আসলেই তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে। এসপি সাহেব বাবাকে ডেকে নিয়ে অর্ডার দিয়েছিলেন। বাবা বাসায় খাবার টেবিলে সে কথা বলেছিলেন। সে দিন বাবার খুব মন খারাপ দেখেছি। বাবা বলেছিলেন, এসপি সাহেব এ কাজটা আমাকে দিয়েই করাতে চান। পুলিশে তো আরো লোক আছে, কিন্ত এসপি বেছে নিলেন আমাকে। কাবেরী সে দিন বাবাকে প্রশ্ন করেছিলো, বাবা এতে সমস্যা কি তুমি তো কত লোককেই গ্রেপ্তার করো। বাবা খুব গম্ভীর হয়ে জবাব দিয়েছিলেন, মা একমাত্র ওই লোকটাই তো বাঙ্গালীদের অধিকার আদায়ের জন্য কিছু করছেন। বাকী নেতারা তো কেউ সরকারের দালাল আবার কেউ বিভ্রান্ত আবার অনেকের সত্য বলার সাহস নেই, নিজেদের সততাও নেই। শেখ মুজিব সৎ ও সাহসী নেতা হিসেবে নিজেকে পরিচিত করাতে পেরেছেন। সে জন্য দিনে দিনে দ্যাখো দেশের বিশেষ করে যুব সমাজ তার দিকে ঝুকেছে। একদিন এই যুব সমাজই তো দেশের নেতৃত্ব দেবে ।

মাওলানা ভাসানীর  প্রতি দেশের মানুষের ভরসা ছিলো। উনি কি কাজটা করে ফেললেন, দেশের মানুষ যখন আইয়ুব খানের যন্ত্রনায় অতিষ্ঠ। সে সময়ে ভাসানী সাহেব বললেন, 'ডন্ট ডিসটার্ব আইয়ুব।' আমি ভাসানী ভক্ত মানুষ, তবে তার এ কথায় খুব কষ্ঠ পেয়েছি। শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের এখন পড়ন্ত বেলা। আশা ভরসা ছিলো মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে নিয়ে, এখন তিনিও দেখছি অন্যরকম হয়ে যাচ্ছেন। তা হলে বাঙ্গালীদের ভবিষ্যত কি? শেখ মুজিব এখনো বয়েসে তরুন। তাকে ঠেকিয়ে রাখতে নানা পদের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। কথা বললেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সে দিন পত্রিকায় দেখলাম মোনায়েম খান বলেছেন, ৬ দফা দাবী থেকে সরে না আসলে শেখ মুজিবকে কারাগারেই থাকতে হবে। সে কখনো সুর্যের আলো দেখতে পাবে না।' এটা কোন কথা হলো। লোকটা কি পাগল নাকি? দেশের একজন সিভিল নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্র কি এমন ভাষায় কথা বলতে পারে?  মেজাজ খারাপ করেই বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন ফনি ভূষন মিত্র।

রাতে বাসায় ফিরে কাবেরীর বাবা বললেন,যাক এবারের মত বাচাঁ গেছে। শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করতে হয়নি।  নারায়নগঞ্জ থেকে কুমিল্লায় আসার পথেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করে নারায়নগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়েছে,তিনি কুমিল্লায় আসতে পারেননি। তবে কুমিল্লায় চারজন ছাত্রকর্মীকে আটক করা হয়েছে। এরা ' আমাদের বাচাঁর দাবী-৬দফা'নামের একটি পুস্তিকা হাটে বাজারে বিলি করছিলো। সে জন্য তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের কাছে অনেকগুলো পুস্তিকা পাওয়া গেছে। পুলিশ সেগুলো জব্দ করেছে। পুস্তিকাগুলো এসপি অফিসে এনে রাখা হয়েছে। আমি একখানা পুস্তিকা লুকিয়ে নিয়ে এসেছি। রাতে পড়ে দেখবো,আসলে ৬ দফায় কি আছে। কি কারনে আইয়ুব খানের সরকার ৬ দফা ঘোষনার পর,শেখ মুজিবের ওপর এতটা চটেছে। খাবার টেবিলেই পুস্তিকাটা রাখা আছে. কাবেরীর ইচ্ছে হলো পুস্তিকাটি নিয়ে সে একবার পড়ে দেখবো। হাত বাড়িয়েও আবার গুটিয়ে নিলো,মায়ের বকুনির ভয়ে। কাবেরী বুঝে এটা রাজনীতির বই,এটায় হাত দিলে অবধারতি মা বকুনি দেবেন। ভাবলো ঠিক আছে,আগে বাবা পড়েনিক,তারপর লুকিয়ে সে পড়ে নেবে।

এর মধ্যে মমতাজ আপার সঙ্গে বেশ ভাব জমে উঠেছে কাবেরীর। মুজিব ভাইকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সে দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট। কোন ক্লাস হয়নি। মমতাজ আপা,সাথীসহ ছাত্রলীগের অন্যান্য কর্মীরা ক্লাসে গিয়ে সবাইকে বের করে এনেছে। শিক্ষকরাও বাধা দেননি। সবার মধ্যেই এক ধরনের আনন্দ, আজ ক্লাস করতে হবে না। স্কুলের মাঠে মিটিং হবে, সবাই জড়ো হয়েছে। ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ছাত্রনেতারা এলেন,মমতাজ আপা আগে বক্তৃতা করলেন,এরপর বাহার নামের একজন ছাত্রনেতা, তারপর আফজাল খান এবং সব শেষে সৈয়দ রেজাউর রহমান ও আলী ইমাম  বক্তৃতা করলেন। সবাই মুজিব ভাইর মুক্তি চাইলেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের লোকেরা আমাদেরকে কি ভাবে শোষন করছে তার বিবরন দিলেন।

মিটিং শেষে ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র নেতারা চলে গেলেন,আমাদের কলেজের ছাত্রীরাও চলে গেল। আমি সাথীর জন্য দাড়িঁয়ে আছি,একসঙ্গে বাসায় ফিরবো। মমতাজ আপা এবং সাথী একসঙ্গে এলেন, বললেন,চলো কিছু নাস্তা করি। কলেজের পাশে একটি চায়ের দোকানে গেলাম আমরা। অন্যান্য খাবারও আছে দোকানটিতে। দেখলাম এখানের সবাই মমতাজ আপাকে চিনেন। বেশ খাতির যন্ত্র করে আমাদেরকে ভেতরে বসতে দিলেন। আমরা সিঙ্গারা এবং চা খেলাম।

সে দিন মমতাজ আপা তার রাজনীতিতে আসার কাহিনী শুনালেন আমাদের। সেটা ১৯৫৪ সালের কথা। পাকিস্তানে নির্বাচন চলছে। আমাদের ব্রামনবাড়িয়ার কসবা থানায় নির্বাচনী জনসভা করতে এলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী,শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এবং সে সময়ের তরুন নেতা শেখ মুজিব। কসবায় তখোন মুসলিম লীগের প্রতাপশালী নেতা তোফাজ্জেল আলী। তিনি টি,আলী নামে পরিচিত। টি আলী তার গুন্ডাবাহিনী দিয়ে জনসভা ভেঙ্গে দিলেন। নেতারা জনসভা করতে পারলেন না। আমার  বাবা আবদুল গনি ভুইয়া পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময়ে মুসলিম লীগের রাজনীতি করতেন। কিছু দিন পর তিনি মুসলিম লীগ ছেড়ে আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দিলেন। জনসভা করতে না পেরে নেতারা যখন ফিরছিলেন সে সময়ে  বাবা নেতাদেরকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসলেন। তাদেরকে দুপুরে খাওয়ালেন। আমার মা নিজ হাতে রান্না করেছিলেন। সে দিনই আমি প্রথম এ সব নেতাদের কাছ থেকে দেখি। মুজিব ভাই তখোন হালকা-পাতলা লম্বা একজন মানুষ। শরীরে তেমন মাংস নেই। আমার বাবাকে ডেকে উঠানে নিয়ে অনেক সময় ধরে  কথা বললেন।

আমার ফুফাতো ভাই খবিরউদ্দিন তখোন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র এবং ছাত্রলীগের নেতা। তিনি বাড়িতে এলে আমাকে বলতেন,মমতাজ তোকে রাজনীতি করতে হবে। তোকে ছাত্রলীগের নেত্রী বানাবো। খবির ভাইয়ের কাছ থেকে আমি প্রথম ছাত্রলীগের নাম শুনি,এবং রাজনীতি করার আহব্বান পাই। এরপর ম্যাট্রিক পাশ করে ঢাকার ইডেন কলেজে ভর্তি হই। বাবা আমার থাকার জন্য পুরান ঢাকার দীন নাথ সেন লেনে একটি বাসা ভাড়া নেন। ঢাকায় আসার পর একদিন খবির ভাই আমাকে শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। মনি ভাই তখোন ছাত্রলীগের নেতা। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে শেখ ফজলুল হক মনি আমাকে এতটা কাছে টেনে নিলেন,যেন আমি তার আপন ছোট বোন। শেখ ফজলুল হক মনি শেখ মুজিব ভাইর  আপন ভাগনে। খবির ভাই আরেকদিন নিয়ে নিলেন এনায়েতুর রহমানের কাছে, এনায়েতুর রহমান তখোন ডাকসুর ভিপি,আমাদের কুমিল্লার ছেলে। সব খানেই রাজনীতি করার উৎসাহ পেলাম। বিশেষ করে মনি ভাইর কাছ থেকে। মনি ভাই আমাকে ইডেন কলেজে ছাত্রলীগ সংগঠিত করার দায়িত্ব দিলেন। সেটা ১৯৬২ সাল। পূর্ব পাকিস্তানে তখোন হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিলের জন্য প্রবল ছাত্র আন্দোলন চলছে। শেখ ফজলুল হক মনি -শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ওই আন্দোলনের সামনের সারির নেতা। আমি পুরাপুরিভাবে আন্দোলনে সামিল হয়ে গেলাম। রাজনীতিই আমার ধ্যানজ্ঞান হয়ে উঠলো। শেখ ফজলুল হক মনিকে তখোন পুলিশ হন্যে হয়ে খুজঁছে। ঢাকা শহরে তার পালানোর জায়গা নেই। কেউ তাকে বাসায় জায়গা দিতে চায় না,পেছনে ভয় আবার পুলিশ যদি তাদেরকেও ধরে নিয়ে যায়। মনি ভাইকে যদি পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারে তা হলে শিক্ষা আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়বে। শাহ মোয়াজ্জেম গ্রেপ্তার হয়ে গেছেন। এ সময়ে একদিন মা বললেন,তা হলে মনিকে বল,আমাদের বাসায় এসে আত্মগোপন করতে। আমি মায়ের কথাটা মনি ভাইকে জানালাম। এরপর মাঝে মাঝে মনি ভাই আমাদের দীন নাথ সেনের বাসায় এসে আশ্রয় নিতেন। ইডেন কলেজ থেকে আমার ইন্টারমিডিয়াট পরীক্ষা দেওয়া হলো না। আমাকে কলেজ থেকে বের করে দেওয়া হলো আন্দোলন করার অপরাধে। কুমিল্লায় ফিরে এলাম। মনি ভাইর পরামর্শে কুমিল্লা মহিলা কলেজে ভর্তি হলাম।

কাবেরী বেশ খুশি। কলেজে নির্বাচনের তারিখ ঘোষনা করা হয়েছে। জীবনের প্রথম ভোট দেবে,এটা এক আলাদা অনুভূতি। কলেজে  দু'টি প্যানেল হলো। একটি ছাত্রলীগের অন্যটি সরকারী দলের। ওদের নাম এনএসএফ। কাবেরী ওদের খবরও নেয় না। সে মমতাজ আপা ও সাথীর জন্য ভোট চায়। এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটলো এনএসএফ এর প্যানেলের একটি মেয়ে কাবেরীকে বললো,ও হলো হিন্দু। ও তো ছাত্রলীগের জন্য ভোট চাইবেই। ওরা তো একই। ছাত্রলীগ হলো হিন্দুদের দল। কথাটা শুনে কাবেরীর খুব কাদঁতে ইচ্ছে করলো। সে তো কোন দিন হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ করেনি, এটা নিয়ে ভাবেনি। সাথী তাদের বাসায় যায়, ওর মাকে মাসী বলে ডাকে। ওদের বাসায় খায়। ও নিজে সাথীদের বাসায় নিজে পাতিল থেকে ভাত নিয়ে খায়। এমন কথাতো কোন দিন শুনেনি। কলেজে আজ সে প্রথম হিন্দু-মুসলিম নিয়ে কথা শুনলো। ওদের পক্ষে ভিক্টরিয়া কলেজ থেকে কয়েকজন ছাত্রনেতা এসেছিলো, তারা পরিচিতি সভায় বক্তৃতা দিয়ে বলেছে, শেখ মুজিব হলো ভারতের দালাল-হিন্দিুদের দালাল। শেখ মুজিবের অনুসারী ছাত্রলীগও তাই। ওরা দেশটাকে ভারত বানাতে চায়। শেখ মুজিব কোন দিন ক্ষমতায় আসলে পাকিস্তান আর পাকিস্তান থাকবে না। আমাদের সোনার পাকিস্তান হিন্দুস্থান হয়ে যাবে। কথাগুলো শুনে আরো মন খারাপ হয়ে গেল কাবেরী। সে কথাগুলো মমতাজ আপাকে বললো। মমতাজ আপা কাবেরীকে শান্তনা দিয়ে বললো, বোন ধর্মই হলো ওদের পূজি, ওদের ব্যবসা। এই ধর্মের কথা বলেই ওদের নেতা জিন্না পাকিস্তান বানিয়ে ছিলো। আজ সেই পাকিস্তানের কোথায় ধর্ম আছে। ওরা ধর্মের কথা বলে সব অধর্মের কাজ করছে। ওদের কথায় মন খারাপ করোনা,ওদের কথায় কান দিও না। ধর্মের কথা বলে ওরা যাতে আর অধর্ম না করতে পারে সেজন্যই আমাদের সংগ্রাম।

লেখক: লায়েকুজ্জামান, সিনিয়র সাংবাদিক