নিজস্ব প্রতিবেদক | আপডেট: মঙ্গলবার, নভেম্বর ৩০, ২০২১
শতবছর
আগে রুশ দেশে যে
বিপ্লব হয়েছিল সে বিপ্লবের তাৎপর্য
সাংস্কৃতিকভাবে তুলে ধরা আজকে
খুবই প্রয়োজনীয়। কিছু কিছু অনুষ্ঠানের
শুরুতে আমরা কিছু মূল্যবান
গান শুনে থাকি। সে
গানগুলোতে সমাজ বাস্তবতা উন্মোচিত
হয়। সে সব শিল্পী
চর্মচক্ষে দেখতে পান না হয়তো,
কিন্তু মনের মধ্যে স্পষ্ট
দেখেন দেশের অবস্থাটা এখন কী। গানগুলো
একটা কথাই বলে—আমরা
আছি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার যে চরম রূপ,
তার ভেতরে। আমি এই কথাটায়
আবার ফিরব।
আমরা
জানি যে, সংস্কৃতিকে সংজ্ঞায়িত
করা কঠিন। সংস্কৃতির মধ্যে আমাদের আত্মপরিচয় আছে, জীবনাচার আছে,
আচার-ব্যবহার আছে, শিল্প-সংস্কৃতি
আছে। সংস্কৃতির ভেতরেই এরা আছে বলা
যাবে। আবার আছে আমাদের
সংগ্রাম। বাঁচার জন্য মানুষের সংগ্রাম,
প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম, প্রবৃত্তির সঙ্গে সংগ্রাম। সংস্কৃতিতে রয়েছে সব কিছু। আমরা
বলে থাকি যে, শিক্ষাই
জাতির মেরুদণ্ড। কিন্তু আসল মেরুদণ্ড হচ্ছে
সংস্কৃতি এবং দেখা যাবে
যে এটা সভ্যতার চাইতেও
সংস্কৃতির গুরুত্ব বেশি এবং স্থায়ী।
আমরা সভ্যতার পতন দেখি, কিন্তু
সভ্যতার পতনের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতি শেষ হয়ে যায়
না। সংস্কৃতির সৃষ্টিগুলো, সংস্কৃতির অর্জনগুলো, সংস্কৃতির মূল্যবোধগুলো রেখে যায় পরবর্তী
ইতিহাসের জন্য। ঝড়ে জাহাজ বিধ্বস্ত
হয়ে রবিনশন ক্রুশো সাঁতরে গিয়ে উঠেছিল নির্জন
এক দ্বীপে। তার জন্য সহায়ক
কিছুই ছিল না, কিন্তু
ভেতরে ছিল তৎকালীন বিকাশমান
পুঁজিবাদী সংস্কৃতি। তারই জোরে তিনি
বেঁচেছেন, নির্জন দ্বীপে ২৩ বছর টিকে
থেকেছেন, প্রকৃতির সঙ্গে সমঝোতায় এসেছেন, ফসল চাষ করেছেন,
ছাগলের খামার তৈরি করেছেন, তোতা
পাখির সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন, বাইবেল পড়েছেন, দিনলিপি লিখেছেন, বিপন্ন একজন মানুষকে আশ্রয়
দিয়ে তাকে সঙ্গী ও
সহকারী হিসেবে কাজে লাগিয়েছেন এবং
অপেক্ষা করছেন উদ্ধারকারীর জন্য। উদ্ধারকারী শেষ পর্যন্ত এসেছেও,
ঘটনাক্রমে। ভেতরে জোরটা ছিল সংস্কৃতির, সপ্তদশ
শতাব্দীর প্রথমার্ধের ইংরেজ সংস্কৃতির জোরটা না থাকলে রবিনশন
ক্রশো মারা পড়তেন নিশ্চিত।
আমরা
দেখব, সভ্যতার যে বিবর্তন হয়েছে
সেই বিবর্তনে নতুন নতুন পর্যায়
পার হয়েছে এবং এই পর্যায়গুলোর
সঙ্গে সংস্কৃতির যে সম্পর্ক সেটা
অত্যন্ত নিবিড়। আমরা এটা জানি
যে, এক সময় আদিম
সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত ছিল।
মানুষ যা পেত তাই
খেতো। গাছ থেকে ফল
ছিঁড়ে খেতো, পানি থেকে মাছ
তুলে খেতো। তখন উদ্বৃত্ত বলতে
কিছু ছিল না। তারপরে
সভ্যতা এগিয়েছে। সভ্যতার সেই অগ্রগতিতে পিতৃতান্ত্রিকতা
এসেছে, ব্যক্তি মালিকানা এসেছে। আমরা দেখেছি যে
দাস সমাজ একসময় প্রতিষ্ঠিত
হয়েছিল। তারপরে সেটা ভেঙে সামন্ত
সমাজ এলো, তারপর সেটা
ভেঙে পুঁজিবাদী সমাজ এলো—এগুলো
সবই অগ্রগতি। একটাকে ছাড়িয়ে আরেকটার নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে মানুষ।
কিন্তু ওই যে দাস
সমাজ, ওই যে সামন্ত
সমাজ, বর্তমানের পুঁজিবাদী সমাজ—এদের ভেতরে
একটা জায়গায় মিল আছে, সেটা
হলো ব্যক্তি মালিকানা। অগ্রগতির ৩ স্তরেই ব্যক্তি
মালিকানা প্রতিষ্ঠিত ছিল। যে বিপ্লব
ঘটেছে সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯১৭ সালে, সেই
বিপ্লব এই মালিকানার প্রশ্নকে
সামনে নিয়ে এসেছিল। মালিক
কী ব্যক্তি থাকবে, নাকি মালিক হবে
সমাজ? উৎপাদন করে অনেকে মিলে
একসঙ্গে, কিন্তু মালিকানা ছিল অল্প কিছু
মানুষের হাতে।
এই
যে মালিকানার সমস্যা তা পুঁজিবাদ সমাধান
করতে পারেনি। সেজন্যই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রয়োজন হয়েছিল। বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দৃষ্টান্ত
স্থাপিত হয়েছিল সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার। আমরা জানি সোভিয়েত
রাষ্ট্র ৭২ বছর টিকে
ছিল। ইতিহাসে আমরা আরও অনেক
বিপ্লব দেখেছি। আমরা ফরাসী বিপ্লবের
কথা জানি, শিল্প বিপ্লবের কথা জানি, আমেরিকার
স্বাধীনতার যুদ্ধের কথা জানি, আমাদের
সিপাহী অভ্যুত্থান বৈপ্লবিক ছিল বলি, আমাদের
মুক্তিযুদ্ধকেও বৈপ্লবিক বলি। কিন্তু এই
যে অক্টোবর বিপ্লব, তা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
কেননা সেই বিপ্লব মালিকানা
উচ্ছেদের প্রশ্নের মীমাংসা করতে চেয়েছিল। অন্য
বিপ্লবগুলো ব্যক্তি মালিকানাকে রক্ষা করে চলেছে। সোভিয়েত
বিপ্লব আমাদের সামনে যে প্রশ্ন এনেছে
সেটা হলো, সম্পদের মালিক
কে? মালিক কি অল্প কয়েকজন
মানুষ? শতকরা ৫ জন নাকি
৯৫ জন? পুঁজিবাদ ৫
জনের পক্ষে এবং পুঁজিবাদী নৃশংসতা,
বর্বরতা, অমানবিকতা আজ সর্বত্র উন্মোচিত।
কাজেই এই বিপ্লবের তাৎপর্য
হচ্ছে, সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, এই
বিপ্লবের বিষয়টি সামনে নিয়ে এলো—কোনটা
বড়? মুনাফা নাকি মানুষ? পুঁজিবাদ
মুনাফাকে বড় করে দেখে,
মুনাফা ছাড়া সে কিছুই
বোঝে না। সমাজতন্ত্র মানুষ
বোঝে, মনুষ্যত্বকে গুরুত্ব দেয়। এ জন্য
সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠার, মুনাফাখোরি ভাঙার। অক্টোবর বিপ্লবের বিশেষ বিশেষত্ব হচ্ছে, এই বিপ্লব বলেছে
মুনাফা নয়, মনুষ্যত্বকেই প্রতিষ্ঠা
করতে হবে।
মুনাফার
রাজত্বে কি ঘটে তা
আমরা দেখেছি। আমরা ২টি বিশ্বযুদ্ধ
দেখেছি। আজকে বর্বরতা দেখছি।
সমাজতন্ত্র থেকে সরে গেলে
রাষ্ট্রের চেহারা যে কি দাঁড়ায়
তা আমরা রাশিয়াতে দেখলাম,
চীনে দেখছি। বলা হয় সমাজতন্ত্রের
পতন ঘটেছে। আসলে তা নয়।
সমাজতন্ত্র থেকে রাষ্ট্রগুলো সরে
গেছে। রাশিয়া যখন সমাজতন্ত্র থেকে
সরে পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠা করলো, তখন অন্যসব দুর্দশার
মধ্যে প্রধান হয়ে দাঁড়ালো নারীদের।
যে নারীরা মর্যাদার আসনে ছিলেন তাদেরই
মধ্যে অনেকে বিপ্লব-পূর্ববর্তী সময়ের মতো দেহ বিক্রি
করতে বের হলেন। মর্যাদা
নিয়ে থাকা অধ্যাপকদের অনেকে
ভিক্ষা করতে বের হলেন।
আমরা
দেখেছি, চীন যখন সমাজতান্ত্রিক
ছিল তখন সে সারাবিশ্বের
সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে সমর্থন দিতো। কিন্তু চীন যখন থেকে
পুঁজিবাদী অবস্থান গ্রহণ করেছে তখন থেকে মানুষের
মুক্তির বিষয়টিকে প্রাধান্য না দিয়ে জাতীয়তাবাদী
স্বার্থ, পুঁজিবাদী স্বার্থ, মুনাফার স্বার্থকে বড় করে তুলেছে।
সে কারণেই আজকে মিয়ানমারে যে
ঘটনা ঘটছে, যে গণহত্যা হয়েছে,
সেখানে বর্বর, সামরিক, ফ্যাসিবাদী শাসকদের চীন সমর্থন করছে।
রাশিয়া তার সঙ্গে যুক্ত
হয়েছে। মুনাফাকে তারা প্রধান করে
তুলেছে, মনুষ্যত্বকে নয়। রুশ বিপ্লব
বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, সে মুনাফায় নয়
মনুষ্যত্বে বিশ্বাস করে। (চলবে)
সিরাজুল
ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়