ফ্রিডম বাংলা নিউজ

শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪ |

EN

আবদুল জলিলের ট্রাম্পকার্ড ও আমানউল্লাহ আমানের ১০ ডিসেম্বর

আরিফ ইশতিয়াক রাহুল | আপডেট: রবিবার, নভেম্বর ২৭, ২০২২

আবদুল জলিলের ট্রাম্পকার্ড ও আমানউল্লাহ আমানের ১০ ডিসেম্বর

২০০৪ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল আচমকা ঘোষণা দেন, ৩০ এপ্রিল জোট সরকারের পতন ঘটবে। একই সাথে জানান, তার কাছে এমন একটি ট্রাম্পকার্ড আছে যা প্রয়োগ করলে জোট সরকারের পতন হবেই।


উল্লেখ্য যে, তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ও বর্তমান বিরোধী দল বিএনপির রাজনৈতিক শক্তিমত্তা, সাংগঠনিক দৃঢ়তা ও আন্দোলনের সামর্থ্যের ব্যবধান আকাশ-পাতাল। সে সময় আওয়ামী লীগের হরতাল মানে সারাদেশ অচল, আর আওয়ামী লীগের অবরোধ মানে পথে-ঘাটে পিনপতন নীরবতা। বর্তমান বিএনপির মতো আন্দোলন-সংগ্রামে খেই হারিয়ে ফেলা বিরোধী দল নয়। আর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আসা প্রবীণ নেতা আবদুল জলিল। যার মুখ থেকে এ রকম ঘোষণা আসা মানে সেটা আসলেই ফেলে দেওয়ার মতো কথা নয়।


হয়েছিলোও তাই। মাসব্যাপী ছিলো রাজনৈতিক মহলে উত্তেজনা, আলোচনা-সমালোচনা। দিন যতোই ঘনিয়ে আসছিলো আবদুল জলিলের অবস্থানও ততোই দৃঢ় হচ্ছিলো। তিনি তার ঘোষণায় অনড় ছিলেন। ২৯ এপ্রিল রাতেও বিবিসির কাছে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ৩০ এপ্রিলই জোট সরকারের পতন ঘটবে। ৩০ এপ্রিল সকাল থেকে দিনভর মানুষ অপেক্ষা করে ঢাকায় কি হয় তা জানার জন্য, সরকারের পতন না হলেও বঙ্গবন্ধু এভিনিউ বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ঘটনা ঘটে কি না তা নিয়েও জনগণের আগ্রহের কমতি ছিলো না।


কিন্তু না। ৩০ এপ্রিল কিছুই হয় নি। সরকারের পতন বা ট্রাম্প কার্ডের প্রয়োগ তো দূরের কথা, কোনো মিছিল বা সভা-সমাবেশও হয় নি। মূলত এটা ছিলো আওয়ামী লীগের একটি কৌশল। কিছু না করেও সরকারের ভীত কাঁপিয়ে দিয়েছিলো তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়েছিলো জোট সরকার। আওয়ামী লীগের ফাঁদে সেসময় বিএনপি শুধু পা'ই দেয় নি, গদি বাঁচাতে তারা বাড়িয়ে দিয়েছিলো আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন ও মামলা-হামলা। যা সে সময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা আওয়ামী লীগের জনসমর্থন বাড়াতে আরও সাহায্য করেছিলো।


১৮ বছর আগে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ যেই মাইন্ড গেম খেলেছিলো ১৮ বছর পরে সেই একই গেম খেলতে নেমেছে বিএনপি। ২০০৪ এর এপ্রিলে আবদুল জলিল ঘোষণা দিয়েছিলেন, ৩০ এপ্রিল জোট সরকারের পতন ঘটাবে। আর ২০২২ এর নভেম্বরে আমানউল্লাহ আমান ঘোষণা দিয়েছেন, ১০ ডিসেম্বরের পর থেকে খালেদা জিয়ার কথায় দেশ চলবে; যার পরোক্ষ অর্থ বিএনপির ক্ষমতা দখল বা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করাকেই ইঙ্গিত করে। রাজনীতিতে রণক্লান্ত, আন্দোলন-সংগ্রামে বার বার পরাজিত ও দূর্বল বিএনপির পক্ষে যা সম্ভব নয় বললেই চলে।


আবদুল জলিল ছিলেন আওয়ামী লীগের দাপুটে নেতা ও সাধারণ সম্পাদক। অন্যদিকে আমানউল্লাহ আমান ঢাকা মহানগরের দায়িত্বে থাকলেও দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। ছিলেন ডাকসুর ভিপিও। তার আল্টিমেটাম অগ্রাহ্য করার কোনো সুযোগ নেই; যেমনটা ছিলো না আবদুল জলিলের আল্টিমেটামেও। তারপরও অনিশ্চয়তার রাজনীতিতে কিছু কথা থেকেই যায়। দিন-ক্ষণ জানিয়ে দিয়ে সরকার পতনের নজির শুধু আমাদের দেশে নয়, বরং উপমহাদেশের রাজনীতিতেও বিরল। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমনটা সম্ভব নয়। এটা শুধুমাত্র সরকারকে চাপে ফেলার একটা মাইন্ড গেম। যার ফলে সরকারের সকল মনোযোগ একদিকে গিয়ে ঠেকবে, বিরোধী দল দেশের রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসবে ও সরকার পতনের অপেক্ষায় থাকা দলীয় নেতা-কর্মীদের মনোবল আরও দৃঢ় হবে।

রাজনীতিতে এ রকম মাইন্ড গেম খুব ইফেক্টিভ হলেও বিএনপি এতোদিন এর ধারেকাছেও ছিলো না। শেষ পর্যন্ত যদিও মাইন্ড গেমে নেমেছে, কিন্তু ভুল করেছে শুরুতেই। আমানউল্লাহ আমানরা ভুলে গিয়েছিলো, রাজনীতিতে কোনো মিস্ট্রি একবার ওপেন হয়ে গেলে তা আর মিস্ট্রি থাকে না। রাজনীতি সচেতন স্কুল পড়ুয়া ছাত্রও বুঝে ফেলে। এক সময় সরকার পতন ও কাল্পনিক ট্রামকার্ডের ঘোষণা দিয়ে আবদুল জলিল এক ঘাটে জল খাইয়েছিলেন সরকার, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাকে। বর্তমান সময়ে প্রায় একই রকম ঘোষণা দিয়ে হাস্য রসের সৃষ্টি করেছেন আমানউল্লাহ আমান। সমালোচিত হয়েছেন নিজ দলেও। কেননা দিনক্ষণ দিয়ে সরকার পতনের রাজনীতির মিস্ট্রি ওপেন হয়ে গেছে আরও ১৮ বছর আগেই। আবদুল জলিলের কাছে প্রকৃতপক্ষে কোনো ট্রামকার্ডই ছিলো না, তবুও মানুষ বিশ্বাস করেছিলো, তার কাছে সরকারের পতন ঘটানোর মতো কোনো ট্রামকার্ড আছে। অপরদিকে আমানউল্লাহ আমানের ঘোষণার পর ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা তো দূরে থাক, তার আগেই মানুষ বুঝে গেছে, ১০ ডিসেম্বরও ৩০ এপ্রিলের মতোই একটি দিন, এ দিন কিছুই হবে না, এটা পলিটিক্যাল রেটোরিক্স মাত্র।


আরিফ ইশতিয়াক রাহুল
নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।