আমরা কেনো পদ্মা সেতুর ছবি-ভিডিও-নিউজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বার বার শেয়ার করি জানেন? আমি আমার বেড়ে ওঠার পুরো সময় জুড়ে দেখেছি, আমার চারপাশের একদল মৌলবাদী মিছিলে স্লোগানের নামে আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে যাচ্ছেতাই ভাষায় গালাগালি করতো। তাদের গালাগালি থেকে রেহাই পায়নি স্বয়ং বঙ্গবন্ধুও। হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকে যেখানেই রাজনৈতিক আলাপ শুনতাম সেখানেই দাঁড়িয়ে যেতাম। পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক শুনতাম। আওয়ামী লীগের পক্ষে যারা তর্ক করতো তারা বিভিন্ন কারণে তর্কে এগিয়েই থাকতো সব সময়। কিন্তু তারা সকলেই তর্কে খেই হারিয়ে ফেলতো যখন পদ্মা সেতুর প্রসঙ্গ আসতো, সৈয়দ আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণের প্রসঙ্গ আসতো। বিএনপি-জামাতপন্থী অনেকেই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু করার প্রসঙ্গ এনে অট্টহাসি হাসতো এবং বলতো, পদ্মা সেতু জীবনেও হবে না। তারা আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কথা বলে হাসাহাসি করতো। দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে কথাগুলো হজম করা ছাড়া তখন কিছুই করার ছিলো না।
বয়সে তখন খুবই ছোটো ছিলাম। তর্কের প্রতিত্তোরে তর্ক করার মতো বয়স বা সাহস কোনোটাই ছিলো না। আর তর্ক করার মতো তথ্যের চর্চাও তখনও করতে শিখি নি। আব্বাকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আব্বা, পদ্মাসেতু কি আসলেই হবে না কখনও? আব্বা বলেছিলো, আমাদের নেত্রী যেহেতু বলেছে সেহেতু পদ্মা সেতু হবেই। রাজনৈতিক বিষয়ে ছোটোবেলা থেকে আব্বা ও মা আমাকে যা যা বলেছে ও বুঝিয়েছে হুবহু তা'ই বোঝা ও বিশ্বাস করাই ছিলো আমার ধর্ম। কেননা তারাই আমার রাজনীতির প্রথম শিক্ষক।
ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বদলে গেলো। দশম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী ক্ষমতায় আসার পর প্রকৃত অর্থেই আমাদের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের রাজনীতিতে একক পরাশক্তিতে পরিণত হলো। ততদিনে খালেদা জিয়া ও ড. মোহাম্মদ ইউনুসেরা বুঝে গিয়েছিলেন যে, শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানানো নেহাৎ বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। পদ্মা সেতু হবে না বলে হাসিঠাট্টা করা লোকজনও গর্তে ঢুকে গিয়েছিলো ততদিনে। অনেকে আবার চোখের সামনে আওয়ামী লীগ হয়ে গিয়েছিলো। সবকিছুই দেখেছি, হজম করেছি। পুরনো কথার জবাব মুখের ওপরে সরাসরি দেওয়ার মতো সুযোগ হয়ে ওঠে নি। কিন্তু তাদের মুখগুলো এখনও স্পষ্ট মনে আছে, যেমন মনে আছে পদ্মা সেতু হবে না মর্মে তাদের কথাগুলো। এখনও কানে বাজে তাদের পৈশাচিক হাসির শব্দ।
পদ্মা সেতুর স্বপ্ন আজ আর স্বপ্ন নেই। মাওয়া থেকে জাজিরা ছুঁয়েছে আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু; যে সেতুর স্বপ্নে কেটেছে আমাদের শৈশব-কৈশোর। আমরা এই পদ্মা সেতুর ছবি-ভিডিও-নিউজ বার বার শেয়ার করি তাদের জন্যই যারা দশকভর বিরোধিতা করেছিলো পদ্মা সেতুর। যে কথা মুখের ওপরে বলা হয়ে ওঠে নি ছবি-ভিডিও-নিউজ শেয়ার করে সে কথা না বলেই বলার চেষ্টা করি। চোখে আঙুল দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি, বঙ্গবন্ধু কন্যা যে কথা বলেন তা বাস্তবে পরিণত করেন। আর যা তিনি পারেন না তা তিনি কখনওই বলেন না। পদ্মা সেতুর একেকটা পিলার হওয়ার পর আমরা বুনো উল্লাস করেছি সেই সকল সমালোচনার স্মৃতিগুলোকে মনে করেই। পদ্মা সেতুতে যেদিন প্রথম স্প্যান বসানো হয়েছিলো সেদিনও আমরা বাঁধভাঙা উল্লাস করেছিলাম। স্লোগানে স্লোগানে বলেছিলাম, শেখ হাসিনার অবদান, পদ্মা সেতু দৃশ্যমান। আর শেষ স্প্যান যেদিন বসানো হলো সেদিন তো আনন্দ আর ধরছিলো না। সারা দেশে সে কি উল্লাস মানুষের! দল-মত নির্বিশেষে সকলেই ভূয়সী প্রসংশা করেছে আওয়ামী লীগ সরকারের, আমাদের সাহসী প্রধানমন্ত্রীর।
এমন একটি খুশির দিনেও কিছু লোকের মন খারাপ ছিলো। মুখে কিছু বলতে না পারলেও ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড জ্বলেছে। লুচির মতো ফুলেছে, আবার চুপসেও গেছে। তারা কারা জানেন? এরা তারা যারা শুধু থেকে বলে এসেছে, পদ্মা সেতু কখনওই হবে না! সেতু হওয়ার পরও এরা আনন্দিত হয় নি৷ উল্টো প্রশ্ন করেছে, এখন সাংবাদিকেরা কি নিয়ে নিউজ করবে! এই পদ্মা সেতুর একেকটা পিলার তাদের বুকে গিয়ে বিঁধেছে তীরের মতো। পদ্মা সেতুর একেকটা স্প্যান ছিলো তাদের ব্যঙ্গাত্নক মানসিকতার কফিনের একেকটা পেরেক। পদ্মা সেতুতে যেদিন বাতি জ্বলেছে সেদিন একই সাথে আগুন জ্বলেছে তাদের বুকে। একদিকে পদ্মা সেতু হয়েছে আলোকিত, অন্যদিকে পুড়েছে তাদের মন। তারা কষ্ট পায়; আমরা যখন পদ্মা সেতুর ছবি-ভিডিও-নিউজ শেয়ার করি। নিউজপেপারে, টিভিতে যখন পদ্মা সেতুর নিউজ দেখে তখনও তারা কষ্ট পায়। আমাদের দেওয়া কষ্টের বহুগুণ কষ্ট ফিরে পায় তারা। আর ঠিক সে কারণেই আমরা পদ্মা সেতুর ছবি-ভিডিও-নিউজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বার বার শেয়ার করি, পদ্মা সেতু নিয়ে আমাদের এতো আয়োজন, এতো হৈ-হুল্লোড়, এতো উৎসব। কারণ এই পদ্মা সেতু আমাদের হাজার বছরের অর্জিত ও সঞ্চিত গৌরবগুলোর একটি। হাজারও না পাওয়া জাতির বড় পাওয়ার নাম। প্রতিযোগিতার বিশ্বে আমাদের মাথা তুলে দাঁড়ানোর প্রতীক।
আরিফ ইশতিয়াক রাহুল
শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।